‘চিনি বিবি’র দৌলতে পর্দা উঠল তাজের
একেবারেই ভিন্ন রকম এক ঘটনা ঘটেছে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার তিনআনি এলাকায়। দেশের অন্য সব জায়গায় যেখানে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব সিনেমা হল, সেখানে দর্শকের উদ্যোগে নতুন করে যাত্রা শুরু করল বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হল ‘তাজ’। কেন এবং কী করে এই ঘটনা ঘটল? চলুন, জেনে নিই চলচ্চিত্রের মতোই সেই কাহিনী।
ছবির নাম ‘চিনি বিবি’। শুটিংয়ের জন্য দরকার একেবারে সবুজ-শ্যামল একটি গ্রাম, যেখানে দৃশ্যায়ন হলে দর্শক অকৃত্রিম গ্রামের দেখা পাবেন বড় পর্দায়। তাই পুরো ইউনিট নিয়ে ‘চিনি বিবি’র দল হাজির হয় শেরপুরের তিনআনি এলাকায়। শুটিংয়ের সময় গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় মুগ্ধ হয় পুরো টিম। গ্রামবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনা কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি।
‘চিনি বিবি’ ছবিটি মুক্তি পায় গত ২৪ এপ্রিল। তিনআনি গ্রামে ছবিটির শুটিং হলো, অথচ গ্রামটিতে কোনো সিনেমা হল নেই, মানুষ নিজেদের গ্রামটিকে তাহলে কি দেখতে পাবে না? নিজেদের গ্রাম বলে কথা! গাঁয়ের একমাত্র সিনেমা হল ‘তাজ’, সেটিও বন্ধ ছয় মাস ধরে। কিন্তু ছবি তো দেখতে হবেই। নিজেদের গ্রামকে বড় পর্দায় দেখতে কেমন লাগছে, সেটা পরখ করতে হবে না? গ্রামবাসী সকলে মিলে হাজির হলেন হল মালিক রাজু বাবু গুপ্তের কাছে। তাঁর সঙ্গে দেখা করে সিনেমা হলটি পুনরায় চালু করতে বললে, অর্থ ও লোকবলের কথা বলে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।
তবে এতে দমে যাননি গ্রামবাসী। তাঁরা এলাকার চেয়ারম্যানকে ধরলেন। তাঁর অনুরোধ আর হল মালিকের সহায়তায় ঠিক হলো, সিনেমা হলটি চালু হবে আবার। আবারো আলো পড়বে বড় পর্দায়। কিন্তু সবকিছু গোছগাছ করতে তো লোকবল প্রয়োজন। সেই লোকবল কোথায়? গ্রামবাসীই উদ্যোগী হয়ে ধুয়ে-মুছে সব পরিষ্কার করলেন। ‘চিনি বিবি’ দেখতে হবেই। কারণ, সেখানে রয়েছে তাঁদের চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য। ২৪ এপ্রিল মুক্তি পাবে ছবিটি। এর আগেই চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে, হলের মেঝে পরিষ্কার করে, সিলিং থেকে ঝুল ঝেড়ে সব ঠিকঠাক করে ফেললেন দর্শক। সব প্রস্তুত, এখন ছবি দেখার পালা।
২৪ এপ্রিল সকাল থেকেই নতুন করে শুরু হলো ‘তাজ’। আর যে ছবি দিয়ে ‘তাজ’-এর পুনর্জন্ম, সেই ‘চিনি বিবি’ দেখতে দিন-রাত ভিড় জমাতে শুরু করেন গ্রামবাসী। ‘তাজ’ সিনেমা হলের ম্যানেজার আবদুর রহিম বলেন, ‘গ্রামবাসী ও স্থানীয় চেয়ারম্যানের চাপে আমাদের হলের মালিক সিনেমা হলটি চালু করতে বাধ্য হন। আমাদের হলে মোট ছয়শ আসন আছে। প্রথম চার দিন আমাদের হল ফুল ছিল। টিকেট না পেয়ে লোক ফেরতও গেছে। তবে গতকাল সোমবার, ২৭ এপ্রিল থেকে দিনের শোগুলোতে দর্শক কম হচ্ছে। রাতে কিন্তু ভিড় ঠিকই আছে। কারণ, আমাদের এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ সময় গ্রামের মানুষ সারা দিন ধান কাটে আর রাতের দুই শোতে ‘চিনি বিবি’ দেখে। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ যে ধরনের গল্প শুনতে ও দেখতে ভালোবাসে, সেভাবেই এ ছবিতে তুলে আনা হয়েছে। তাই দর্শকও ছবিটি খুব দেখছে।’
তাজ সিনেমা হলের ম্যানেজার আবদুর রহিম আরো বলেন, “সারা দিনে একজন লোক ধান কেটে পায় সাড়ে ছয়শ টাকা। আর এই সময় আমাদের এলাকায় উৎসবের মতো আমেজ থাকে। এই উৎসবে বাড়তি আনন্দ জুগিয়েছে ‘চিনি বিবি’। কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় ছবি দেখতে হলে আসে। আর গভীর রাতে গান গাইতে গাইতে বাড়িতে যায়। এটা আমাদের অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। কিন্তু আমাদের হল বন্ধ থাকায় অনেক দিন এমন দৃশ্য দেখিনি। এখন মনে হচ্ছে, আমরা ঠিক সময়ে হলটি চালু করেছি।”
হল মালিক রাজু বাবু গুপ্ত বলেন, “দর্শকের উৎসাহ দেখে আমি আনন্দিত। ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে আবারো ‘চিনি বিবি’ রিলিজ দেব। এখন আর সিনেমা হলটি বন্ধ হবে না।”
ছবির পরিচালক নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, “আমার প্রথম ছবি ‘চিনি বিবি’ দর্শকের যে ভালোবাসা পেয়েছে, তা দেখে আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশে যেখানে প্রতিদিন সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমার ছবি দেখার জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ হলটি আবার চালু করল। এর বেশি কী আর চাইতে পারি? তবে যাঁরা নকল গল্প নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন, তাঁদের বলছি, আপনারা আমাদের এই দর্শকের সঙ্গে প্রতারণা করবেন না। গ্রামের গল্প নিয়ে, আমাদের নিজেদের গল্প নিয়ে ছবি বানালে দর্শক দেখবেই।”
২০০২ সালে হলটি নির্মাণ করা হলেও ক্রমাগত লোকসানের মুখে ছয় মাস আগে হলটি বন্ধ হয়ে যায়। গত ২৪ এপ্রিল ‘চিনি বিবি’ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে পুনরায় চালু হয় হলটি। ৬০০ আসনের এ হলের নিজস্ব ডিজিটাল প্রজেকশন সিস্টেম রয়েছে। নজরুল ইসলাম বাবু পরিচালিত ‘চিনি বিবি’ ছবিতে অভিনয় করেছেন মিষ্টি জান্নাত ও জয় চৌধুরী।