খালেদ খানের ৬০তম জন্মদিন পালিত
শিল্পকলা একাডেমির গতকালের বিকেলটা ছিল অন্য রকম। উৎসবের আমেজ ছিল, আবার ছিল শূন্যতার বোধও। অভিনেতা খালেদ খানের ৬০তম জন্মদিন ছিল গতকাল শনিবার। এ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় আয়োজন করা হয় এক অনুষ্ঠানের।
বসন্তের বিকেলে সংগীত, নৃত্য, নাট্যাংশ, তথ্যচিত্রের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হয় খালেদ খানকে। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে ঢোকার আগে শিল্পী মিতা হকের দল সুরতীর্থের পরিবেশনায় গাওয়া হয় রবীন্দ্রনাথের আটটি গান। রবীন্দ্রনাথের পূজা, প্রকৃতি, বিচিত্র পর্যায়ের গান নিয়ে সাজানো হয় গানের সূচি।
অনুষ্ঠান শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গান ‘কবে আমি বাহির হলেম’ দিয়ে। এর পর একে একে চলতে থাকে কান্না-হাসির দোলদোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা, আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে, মোর বীণা ওঠে, বসন্তে ফুল গাঁথল, মধুর মধুর ধ্বনি বাজে, মোরা সত্যের পরে মন, এই কথাটা ধরে রাখিস—এই গানগুলো।
প্রথম পর্যায়ের গান শেষে শিল্পী মিতা হক স্বাগত বাণীতে আমন্ত্রণ জানান অতিথিদের মূল মঞ্চে। সেখানে পরিবেশিত হয় ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ গানটির সঙ্গে নৃত্য। নাচের মুদ্রায় দর্শককে মুগ্ধ করে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। এরপর শোনানো হয় খালেদ খানের কণ্ঠে আবৃত্তি ‘অপেক্ষমাণ’।
আবৃত্তির পর মঞ্চে উঠে আসেন উপস্থাপক ত্রপা মজুমদার। তাঁর আমন্ত্রণে প্রথম পর্বের আলোচনায় মঞ্চে আসেন সংগীতশিল্পী ও খালেদ খানের সহধর্মিণী মিতা হক। মঞ্চে আসেন অভিনেত্রী লাকী ইনাম ও ইউল্যাব বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সহসভাপতি কাজী আনিস। খালেদ খানকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকে আলোচনা।
খালেদ খানের কর্ম, নাট্যশিল্পে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করে লাকী ইনাম বলেন, ‘মানুষ চলে গেলেই কি চলে যায়? যায় না। মানুষ তাঁর কর্মে, স্মৃতিতে, বন্ধুত্বে সব জায়গায় থাকে। যুবরাজও আছে।’
যুবরাজ খুব মেধাবী ছিল জানিয়ে লাকী বলেন, ‘সে পড়াশোনা করত। গভীরভাবে কোনো কিছু ভেবে সাজেশন দিতে পারত। তাঁর অভিনয়ের মধ্যে একটি শক্তি ছিল।’
ইউল্যাব বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সহসভাপতি কাজী আনিস বলেন, ‘খালেদ খান অনেক দিন আমাদের সঙ্গে ইউল্যাবে কাজ করেছেন। ছাত্রদের পড়িয়েছেন। আবার প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেছেন। কাজের বেলায় তিনি ছিলেন খুব দৃঢ়। কিছুতেই ঘাবড়াতেন না। উনার কাছে নীতি খুব বড় ছিল।’
সংগীতশিল্পী মিতা হক বলেন, ‘যুবরাজ অসম্ভব পড়াশোনা করা মানুষ। আমি তাঁর প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলাম মেধা দেখে। সে ফার্স্ট বয় ছিল। আমি কখনো ফার্স্ট হইনি।’
‘পরিবারের বড় ছেলে ছিল সে। নিজের কাজের প্রতি যেমন মনোযোগী ছিল, তেমনি পরিবারের প্রতিটি সদস্যের প্রতিও যত্নশীল ছিল,’ স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন মিতা হক।
যুবরাজের ইচ্ছের কথা জানিয়ে সহধর্মিণী মিতা হক বলেন, ‘তাঁর ইচ্ছে ছিল শিশুদের জন্য একটি প্রি-স্কুল করার। তাঁর এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার ইচ্ছা আমার রয়েছে। তবে পারব কি না জানি না।’
এরপর মঞ্চে অভিনীত হয় ইবসনের ‘ডলস হাউস’ অবলম্বনে নাটক ‘পুতুল খেলা’। কণ্ঠশীলনের প্রযোজনায় এই নাটকের নির্দেশনা ছিল খালেদ খানের। নাটকের পর মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন খালেদ খানের অনুজ জাহিদ খান। ‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ’ গানটি মিলনায়তনে এক অনন্য পরিবেশ সৃষ্টি করে। গানটি গাইবার সময় শিল্পীও আবেগতাড়িত হন।
এরপর দেখানো হয় খালেদ খান অভিনীত মঞ্চনাটকের কিছু স্থিরচিত্র।
এরপর শুরু হয় আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব। খালেদ খানকে নিয়ে কিছু বলার জন্য উপস্থাপক মঞ্চে ডাকেন নাট্যকার মাসুম রেজা, চলচ্চিত্র নির্মাতা আবু সাইয়ীদ ও অভিনেত্রী আফসানা মিমিকে।
নাট্যকার মাসুম রেজা জানান, তাঁর বড় হওয়ার পেছনে ‘যুবদার’ অনেক বড় গাইড ছিল। আবু সাইয়ীদ বলেন, ‘খালেদ খান মঞ্চ, টিভি, চলচ্চিত্র তিন মাধ্যমেই কাজ করেছেন এবং সফল হয়েছেন। আমার কাজের ক্ষেত্রে তিনি মানসিকভাবে খুব সাহায্য করতেন। তিনি ব্যক্তির ভেতর সম্ভবনার জায়গাটা যথার্থভাবে বুঝতে পারতেন।’
যুবদার সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল জানিয়ে অভিনেত্রী আফসানা মিমি বলেন, ‘যুবদার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। আমি উনার সঙ্গে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে কাজ করেছি। এ ছাড়া আরো অনেক কাজ করেছি। আমি যুবদাকে ভয় পেতাম। আমার মনে হতো, উনি আমাকে পছন্দ করছেন না। তবে মানুষ মৃত্যুর পর অনেক বেশি প্রিয় হয়ে ওঠে। যুবদা ভালো গান গাইতেন। অনেক গান শিখেছি যুবদার কাছে।’
দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শেষে মামুন জাহিদের পরিবেশনায় হয় আরেকটি গান। এর পর খালেদ খানের আরেক অনুজ অভিনেতা শাহীন খান ঈর্ষা নাটকটি মঞ্চায়িত করেন। খালেদ খানের একমাত্র কন্যা জয়িতা পরিবেশন করেন ‘না বুঝে কারে তুমি ভাসালে’ ও ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও’ গানটি।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে আবারও সুরতীর্থের আয়োজনে পরিবেশিত হয় ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’ ও ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’ গানগুলো। এভাবেই খালেদ খানের স্মৃতিকে ঘিয়ে শেষ হয় বসন্তের এই আবেগঘন সন্ধ্যা।
খালেদ খান মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর মারা যান।