ভেতরে নজরুল গেঁথে আছে : চন্দনা মজুমদার
লোকসংগীতের খ্যাতনামা শিল্পী চন্দনা মজুমদার। গান গেয়ে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১১ সালে ‘ভবের হাট’ অ্যালবামের জন্য পেয়েছেন সিটিসেল অ্যাওয়ার্ড। স্বামী কিরণ চন্দ্র রায়, বাংলাদেশে আরেক তারকা সঙ্গীতশিল্পী, তাঁর সাথে সুরের অটুট বন্ধনে কাজ করে যাচ্ছেন একের পর এক। বর্তমানে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আর ছায়ানটে শিক্ষকতা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন চন্দনা মজুমদার।
প্রশ্ন : আপনার গানগুলোর মধ্যে মাটির গন্ধ মিশে থাকে। এসব গান কীভাবে সংগ্রহ করছেন?
চন্দনা মজুমদার : একটা বিষয় হলো স্টেজ শো করতে যেখানেই যাই সেখান থেকেই গান সংগ্রহ করার চেষ্টা করি। সে এলাকার আঞ্চলিক শিল্পীদের মুখের গানগুলো থেকে যেসব গান ভালো লাগে সঙ্গে সঙ্গে তা সংগ্রহ করি। গানগুলো সংগ্রহ করার পর প্রকৃত সুরের সন্ধান করি। এরপর আরেকটি বিষয় হলো আমার পরিবার খোদ সংগীত পরিবার। জন্মের পর থেকেই সুরের সঙ্গে বসবাস করে আসছি। আমার বাবা নির্মল চন্দ্র মজুমদার ও কাকু সুভাস চন্দ্র দাসের কাছে অনেক দুর্লভ গানের সংগ্রহ আছে। ছোট থেকেই সেসব দেখে আসছি। তাঁরাই আমাকে এসব গান সংগ্রহ করতে সহযোগিতা করেন। আমাদের মাটির গানগুলো বর্তমানে মূল সুরে অনেককেই গাইতে দেখা যায় না। আমার হাতে কোনো গান এলেই তার মূল শিল্পী ও সুরকে খোঁজার চেষ্টা করি। তারপর তা ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : গানের মূল সুর পেতে হলে মাটির কাছাকাছি যাওয়ার কোনো বিকল্প আছে কি?
চন্দনা মজুমদার : মাটির কাছে, মাটির টানে যেতে হবে। যে অঞ্চলের গানগুলো পাওয়া যায় সেখানে যেতে হবে। প্রথমে ঠিক করে নিতে হবে আমি কি চাচ্ছি। কোন গানগুলোর সুর সাধনা আমি করতে চাই। তারপর সেভাবে সন্ধানে বেরিয়ে যেতে হবে।পুরনো অনেক রেকর্ড আছে সেসব খোঁজ করতে হবে। গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে যেতে হবে মূল সুর খুঁজে পেতে। সে গানগুলো নিজের মধ্যে খুঁজে পেতে কঠিন সাধনা ও চর্চা করতে হবে। এমন অনেক দিন গেছে যখন রাতের পর রাত জেগে আমি এসব গান চর্চা করেছি। ভালো কিছু পেতে হলে সাধনা করতে হবে।
প্রশ্ন : মূল সুর বিকৃত হচ্ছে কেন?
চন্দনা মজুমদার : লোকজ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে গীত হওয়ায় এর অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই সেদিক থেকে সচেতন হতে হবে। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম প্রকৃত সুরে গানগুলো গাইতে পারে। মোট কথা গানগুলোর মূল সুর ঠিক রেখে গাইতে হবে। সংগীত হলো গুরুমুখী শিক্ষা। আমরা ছোটবেলায় সারারাত জেগে থেকে গুরুজীর কাছ থেকে হাতে ধরে শিখেছি। একেকটা শব্দ, নোট, সুর ও তালের তালিম নিয়েছি। রাতের পর রাত কেটেছে প্রকৃত সুর সাধনায়। কোথায় গেলে একটা ভালো গান পাব। ভালো গান করব। তার জন্য সারাক্ষণই ব্যস্ত হয়ে থাকি; কিন্তু বর্তমান সময়ে কেউ ভালোমতো চর্চা করতে চায় না। ভালো গুরুর সঙ্গে বসে না।ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে পরিচিতি পায়, আবার বিলীনও হয়ে যায়। তাহলে প্রকৃত সুরের ধারাটা অব্যাহত থাকবে কীভাবে।
প্রশ্ন : একজন চন্দনা মজুমদার হয়ে ওঠার গল্পটা বলুন।
চন্দনা মজুমদার : ১৯৭৯ সালে আমি বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হই। ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ বেতারের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই। এখনকার মতো এত বেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল তো তখন ছিল না। সে সময় বাংলা একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতাম। ১৯৮৩-৮৪ সালে লালনের ওপর আমার প্রথম ক্যাসেট কনকর্ড থেকে বের হয়। এরপর সারগাম কোম্পানি থেকে একটি লোকসংগীতের অন্যটি লালনের গান নিয়ে প্রকাশিত হয়। তার পরই গীতালি ও সারগাম কোম্পানি থেকে কীর্তন গানের ক্যাসেট বের হয়।এর পর সংগীতা থেকে লালন এবং লোকসংগীতের গানের ক্যাসেট বের হয়। ওই সময়টায় আমার গাওয়া বিভিন্ন ক্যাসেটের গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। 'আমার কাঙ্খের কলসি গিয়াছে ভাসি, ওড়ে কোনো বা ঝাড়ের বাঁশি রে, পরানের ব্যথারে, পিসির জন্য পিসা মসাই, ও রাঁধে রসিয়া তোমারে কে দিল রং মাখাইয়া, পরান বন্ধুরে ভালোবাইসা ও তোর মন পাইলাম না' এর মতো গানগুলো গ্রামবাংলার মানুষের মুখে মুখে শোনা যেত। এ গানগুলো তখন সুপার হিট গান। ধীরে ধীরে আমি সবার মনের মধ্যে ভালোবাসার জায়গা করে নিলাম। ১৯৮৯ সালে বিয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে আমাকে অনেক উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আমার শাশুড়ি মুক্তা রায় আমাকে নিজের মেয়ের মতো করেই সংগীত চর্চার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। তবে একজন চন্দনা মজুমদার হয়ে ওঠার পেছনে বর্তমান সময়ের মিডিয়াকে আমি প্রাধান্য দেব। দেশে অনেক মিডিয়া, অনেক চ্যানেল গড়ে ওঠায় শিল্পীদের জন্য তা বড় পাওয়া। চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠান হয়। তবে লোকসংগীতের অনুষ্ঠান হলে সাধারণ দর্শক-শ্রোতা তা মিস করতে চায় না। কেননা, লোকজ এ গানগুলোর সঙ্গে আমাদের মাটি এবং মনের সম্পর্ক রয়েছে। অন্য যেকোনো গান পাওয়া গেলেও লোকসংগীতের মূল সুরের গানগুলো সংগ্রহ করা কঠিন। এসব অনুষ্ঠান থেকে লোক শ্রোতারা তাদের প্রিয় গানগুলো সংগ্রহ করতে পারে। চন্দনা মজুমদার হয়ে ওঠার আরো বিশেষ জায়গা হলো আমার ভক্ত, দর্শক, শ্রোতা। ২০১১-সালে 'মনপুরা' ছবিতে 'সোনার পালঙ্কের ঘরে লিখে রেখেছিলেম দ্বারে' গানটির জন্য জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার পাওয়াটাও এ ক্ষেত্রে বড় পাওয়া।
প্রশ্ন : ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কিছু বলুন।
চন্দনা মজুমদার : ব্যক্তিগত জীবনে আমি খুবই সুখী। আমার স্বামী এ দেশের খ্যাতনামা বাউল সংগীতশিল্পী কিরণ চন্দ্র রায় এবং একমাত্র কন্যাসন্তান শতাব্দী রায় পিংকিকে নিয়ে আমাদের সংগীত পরিবার। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন সব ক্ষেত্রে কঠিন কাজকে সহজ করে দেয়। এমন খুব অল্প পরিবারকেই দেখা যায় একই স্বামী-স্ত্রী একই পেশায় কাজ করতে। তাদের মধ্যে নানা রকমের বিরোধ, দ্বন্দ্বও দেখা যায়। তবে আমাদের দুজন ভিন্ন ধারার সংগীতশিল্পী হওয়ার পরও কখনো কোনো মতবিরোধ হয় না। দাম্পত্য জীবনে আমি খুবই সুখী।
প্রশ্ন: সংগীতশিল্পী না হলে কী হতেন?
চন্দনা মজুমদার : আমার জন্ম কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে। আমার বাবা নির্মল চন্দ্র মজুমদার লালনের অনুসারী। আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় গানের আসর বসত। ছোট থেকেই আমাদের বাড়িতে বাউলদের এ মেলার আসর আমাকে অনুপ্রাণিত করত। তখন থেকেই গান আমার ভেতরে বসবাস করতে শুরু করে- যা এখন পর্যন্ত চলছে। কখনো অন্য কিছু হওয়ার ইচ্ছা হয়নি। তবে নজরুলের গান আমাকে টানে। বাবা চাইতেন আমি অন্য অঙ্গের গান করি; কিন্তু লোকসংগীত এবং লালনের গান আমার রক্তের সঙ্গে মিশে ছিল। তাই আর কিছু ভাববার সুযোগ হয়নি।
প্রশ্ন : তাহলে বলা যায় চন্দনা মজুমদার নজরুল সংগীতশিল্পী হতেন?
চন্দনা মজুমদার : (হাসতে হাসতে) আসলে এটা বলা মুশকিল। তবে নজরুলের গানের প্রতি আমার বিশেষ ভালোবাসা রয়েছে। বাবার অনুপ্রেরণায় ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে নজরুল পরিষদে আমি পাঁচ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করি। ইয়াকুব আলী খানের কাছে ব্যক্তিগতভাবে নজরুল সংগীত এবং ক্লাসিক্যাল সংগীতের ওপর তালিম নিয়েছি। এরপর তপন বৌদ্ধ ও ওমর ফারুক সাহেবের কাছেও ক্লাসিক্যাল তালিম নিয়েছি। আমার ভেতরে নজরুল গেঁথে আছে। ইচ্ছা আছে আমার আগামী সিডিতে নজরুলের পল্লীগীতি গানগুলো গাইব।
প্রশ্ন : বাসায় তাহলে ছেলেমেয়েদের গান শেখাচ্ছেন?
চন্দনা মজুমদার : শিল্পীরা তাদের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করে, সে শিক্ষাটুকু উত্তরসূরির মাঝে রেখে যেতে চায়। যতটুকু শিখেছি তা ভালো কাউকে দিয়ে যেতে চাই। সে লক্ষ্যেই কিছু ছেলেমেয়েকে নিয়ে সময় পেলেই মাঝেমধ্যে বসার চেষ্টা করছি।
প্রশ্ন : আপনার জীবনে কোনো অতৃপ্তি আছে কি?
চন্দনা মজুমদার : যতটুকু চেয়েছি তার বেশিই পেয়েছি। যত দিন বাঁচব গান গেয়ে যেতে চাই। আজীবন শ্রোতাদের ভালোবাসা আর সুস্থ থেকে সংগীতের সাধনা করে যেতে চাই।
প্রশ্ন : বর্তমানে কী নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
চন্দনা মজুমদার : লালনের একটা সিডি রেডি আছে। কলকাতা যাব রেকর্ডিং করতে। নতুন সিডিতে কিছু গীতিকবির গান থাকবে। কিছু ঢাকা অঞ্চলের গানও থাকবে। তবে নজরুলের পল্লীগানের প্রাধান্য থাকবে নতুন সিডিতে।
প্রশ্ন: ভবিষৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলুন?
চন্দনা মজুমদার : কিছু পরিকল্পনা আছে। গান নিয়েই থাকতে চাই। মনে-প্রাণে চাই আমাদের একমাত্র কন্যাসন্তান সংগীতকে পেশা হিসেবে না নিলেও নেশা হিসেবে নেবে। আর কিছু চাওয়ার নেই।