মধুর ক্যান্টিনের যতকথা
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে নয়, মধুর ক্যান্টিন বা রেস্তোরাঁ শব্দটি পরিচিত প্রায় সবার কাছে। নিছক ক্যান্টিন পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে এর ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অগ্রগামী সব আন্দোলনের সাথে এর রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ৫২ থেকে শুরু করে ৭১ পর্যন্ত এ দেশের তরুণদের অগ্নিকণ্ঠ এখানে কেঁপে উঠেছে যেন বারবার। টুং টাং চায়ের কাপে আলোচনার ঝড় উঠত আর সেই ঝড় রূপ নিত পথের বিশাল মিছিলের। তরুণদের সদাজাগ্রত প্রাণ আর দেশের তরে কিছু করবার বাসনা যেন এখানে এসে পথ খুঁজে পেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আন্দোলনের সূচনাও হয়েছে এখানে।
১৯৪৮ সালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কালো আইনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার করেছিল মধুর ক্যান্টিন। আজও এর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় শোনা যায় ডানপন্থী-বামপন্থীদের তুমুল আলোচনা।
একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক মধুর ক্যান্টিনের জন্মলগ্নের ইতিহাস। মধুর ক্যান্টিন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। ক্যান্টিনের নামকরণ করা হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দে (মধু)-এর নাম থেকে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাবা আদিত্য চন্দ্রের সাথে ঢাকায় আসেন তিনি। মধুসূদন দে ছিলেন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী নানা আন্দোলনে তাঁর ছিল পদচারণা। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। তাই ২৫ মার্চ, ১৯৭১ সালের সেই বর্বর কালরাতে হানাদার বাহিনী তাঁকে জগন্নাথ হল থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং সেই রাত্রেই হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁরই ছেলে অরুণ কুমার দের ওপর ক্যান্টিনের দায়িত্ব অর্পিত হয়।
কলাভবন থেকে কিছুদূর হাঁটলেই ডাকসুর বিপরীত দিকে ক্যান্টিনের দেখা পাওয়া যাবে। এর ফটকের সামনেই রয়েছে মধুসূদন দে’র স্মরণে তাঁর একটি ভাস্কর্য।ক্যান্টিনের ভবনটির প্রতিটি দেয়ালে রয়েছে ঐতিহ্যের ছোঁয়া। আর থাকবেই না কেন? এই ভবনে যে ছিল নবাবদের পদচারণা। আঠারো শতকের শেষের দিকে শুরু হওয়া এই ভবনের কাজ চলে প্রায় বেশ ক’বছর। নির্মাণের সময় অর্থাৎ১৯০৪ সালে ঢাকার নবাবদের বৈঠকখানা হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসে। ভবনের ভিতরে নবাবদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল নৃত্যশালা। তৎকালীন সময়ে ভবনটি ‘দরবার হল’ নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ভবনটিও এর অধীনে চলে আসে।
কী এমন খাবার আছে এখানে যার জন্য হারহামেশাই ভিড় লেগে থাকে। ক্যান্টিনে প্রবেশের পর অবশ্য এই প্রশ্নটুকু বিলীন হয়ে যায়, কেননা মুখরোচক আড্ডা গানে কিংবা তর্কে সাধারণ চা, শিঙ্গারা, সমুচা হয়ে ওঠে অসাধারণ। তবে তাই বলে খাবারের মানে কখনো আপোস করেনি ক্যান্টিন মালিক। ক্যান্টিনের ভিতরের পরিবেশও অনেকটাই স্বস্তিদায়ক, কারণ রয়েছে বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
কথা হচ্ছিল শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী তানজিম হাসানের সাথে। তিনি বলেন, ‘কেবল বর্তমান শিক্ষার্থী নয়, পুরাতনদেরও মেলা বসে এখানে। সিনিয়র ও জুনিয়রের মধ্যে চমৎকার মেলবন্ধন গড়ে ওঠে।’ একটু কষ্ট নিয়েই যেন বললেন, ‘জীবনযুদ্ধে পরাজিত কিংবা বাস্তবতার কষাঘাতে বিপর্যস্ত মানুষের দেখাও মিলে এখানে। সব আশা ভরশা হারিয়ে যেন একটু খানি পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে চলে আসেন।’ ভিতরে প্রবেশের পর আসলেই যেন মনে হবে কত গল্প আর কত স্বপ্নঘেরা এই প্রিয় মধুর ক্যান্টিন।
সবুজে ঘেরা এই ক্যান্টিন শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকেনি অনান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদেরও রয়েছে আনাগোনা। তেমনি একজন বুয়েটে পড়ুয়া জোবায়ের আদনান। রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহবোধ তাঁর।
আড্ডার এক ফাঁকে তিনি বলেন, ‘আসলে সারাদিনে একবার এখানে এসে বন্ধুদের সাথে না বসলে যেন দিনটাই মাটি। রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে বলতে বেলা গড়িয়ে যায়, চায়ের কাপ বদলে যায় তবু যেন কথা শেষ হয় না।’ তবে কিছুটা আফসোসের সুরে বললেন, এখন মূলধারার সুস্থ রাজনীতি বড্ড মিস করেন। ছাত্রদের মধ্যেও যেন নেই সেই আগের গর্জন।
অনেক ভালোলাগা আর খারাপলাগা নিয়ে চিরায়ত এই মধুর ক্যান্টিন। কারো কাছে যেন প্রচণ্ড ভালোবাসা আর মায়ায় ঘেরা এই ক্যান্টিন। সময় করে এখানে বন্ধুদের নিয়ে চলে আসতে পারেন যে কেউ চায়ের কাপে ঝড় তুলতে। তবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে যেন অন্যের মতামতে হস্তক্ষেপ না হয়। কেননা বিব্রত পরিস্থিতি এড়িয়ে চলায় শ্রেয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়