সমুদ্র যাদের শ্রেণিকক্ষ
নীল রঙের কোনো টি-শার্টে যখন লেখা থাকবে ‘The Ocean is our classroom- সমুদ্র আমাদের শ্রেণিকক্ষ’ এবং এর পাশেই যদি কোনো একটা নামিদামি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লোগো থাকবে, তখন আপনার মাথার নিউরনগুলো নাড়া দিবেই। আবার কেউ কেউ এই লেখা সংবলিত টি-শার্ট পরিহিত লোককে পাগলও ভাবতে পারে! কিন্ত যখন আপনি সেই লোকদের সম্পর্কে জানবেন তখন হয়তো নিজেকে নিয়ে গর্ববোধও করতে পারেন। রহস্যময় বটে তবে অনেক তথ্যবহুলও। তাহলে, চলুন আমরা নীল টি-শার্টওয়ালাদের গল্পটাই শুনি....
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে পর্যটন ব্যবস্থা। বিশেষ করে কক্সবাজার, পতেঙ্গা, কুয়াকাটা সমুদ্র-সৈকত কিংবা সেন্ট মার্টিনসহ সমুদ্র্রতীরবর্তী পর্যটন স্পটগুলোতে তিল পরিমাণ জায়গা পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়ে কোনো কোনো সময়। প্রতিবছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় লক্ষনীয়। এসব পর্যটকের আবার রকমফেরও হয়। বিভিন্ন পর্যটকের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও বিভিন্ন হয়। শ্রেণিভেদে পর্যটকদের কিছু কিছু কার্যকলাপও হাস্যরসাত্মক হয়ে থাকে। আবার অনেকের কার্যকলাপ শিক্ষা নেওয়ার মতোও বটে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে এবার দেখা পাওয়া গেল অনন্য পর্যটক ফেরিওয়ালাদের। সবাই একই রঙের টি-শার্ট (নীল রং)পরেছে, যার সামনে লেখা আছে- ‘Exploring the coral island’, পিছনের দিকটাতে লেখা-"The ocean is our classroom" আর অন্য কোনো দিকটাতে আছে-‘University of Chittagong’ । ও হে, এরাই নীল টি-শার্টওয়ালা সামুদ্রিক ফেরিওয়ালা! শুনতে অবাক লাগলেও বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবসত্য। যারা সমুদ্র নিয়ে পড়াশোনা করে, সমুদ্রকে নিয়েছে ক্লাসরুম হিসেবে, গড়েছে সমুদ্রের সঙ্গে মিতালী।
দারুচিনি দ্বীপে গত ০৯/০২/২০১৭ তারিখে তাদের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো, অনেক কিছু জানাও হলো। মোট ৯৩ জনের একটা দল। দেশের অগ্রগণ্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সস অ্যান্ড ফিসারিজের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের মোট ৮৬ জন শিক্ষার্থী, চারজন শিক্ষক এবং তিনজন দক্ষ ফিল্ড টেকনেশিয়ানসহ প্রাণবন্ত দলটি গত ০৭/০২/২০১৭ তারিখে কক্সবাজার গিয়ে পৌঁছেছিল রাত ৯টায়। সেখানে রাত্রিযাপন করে পরের দিন সকাল ৮টায় দলটি পৌঁছাল টেকনাফের দমদমিয়া জেটি ঘাটে। প্রয়োজনীয় রসদ নিয়ে সেন্ট মার্টিনগামী এলসিটি কাজল জাহাজে করে ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দুপুর ১২টার খানিক আগেই তারা পৌঁছাল সেন্ট মার্টিনের ফেরিঘাটে। মূলত সেখান থেকেই তাদের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল । ফেরিঘাট থেকে পুরো দ্বীপের কাঠামো আর সমুদ্রের বিভিন্ন অংশ দেখে নোটে টুকাটুকি করছিল প্রায় সবাই। উদ্দেশ্য হলো, মূল ফেরিঘাট থেকে দ্বীপে কী কী রিসোর্স আছে সেগুলো শনাক্তকরণ এবং ম্যাপের সত্যতা নিরূপণ। দ্বীপের পূর্বপাড়ার কোনো এক রিসোর্টে তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। আগে থেকেই ভাগ করা সবার গ্রুপ অনুযায়ী নির্দিষ্ট শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সৈকতের ভাটার সময় ঠিক ৩টা ৩০ মিনিটে সবাই ছিল সমুদ্রমুখী। ওই দিন বিকেলে নীল টি-শার্টওয়ালা সবাইকে সাগরতীরে একসঙ্গে দেখে মনে হয়েছিল যেন এরাই দ্বীপের কান্ডারী। শিক্ষক মহোদ্বয়ের তত্ত্বাবধানে কেউ পরিলক্ষণ করছিল তীরের ক্ষুদ্র প্রাণীবৈচিত্র্য, কেউ তীরের অল্প মাটির নিচের প্রাণীর প্রাচুর্যতা দেখছিল, কেউ বা সৈকতের ঢালুত্ব নির্ণয়ে ব্যস্ত। বাজারে গিয়ে দেখা যায় একদল শিক্ষার্থী তথ্য নিচ্ছে সাগর থেকে সদ্য মাছ নিয়ে আসা জেলেদের সঙ্গে, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কখনো বা আবার পর্যটকদের সঙ্গে। সবাই ক্লাসরুম/ল্যাবে যেভাবে শিখে সেই আদলেই মনযোগের সঙ্গে সবকিছু করছে। আর সেই সব কাজের সঙ্গেই চলছিল ক্যামেরার ক্লিকবাজি। তাদের থেকে জানা গেল ডিনারের আগে তারা দিনের কাজেগুলোর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের কাজ করবে। তাদের কথা মতো রিসোর্টে গিয়ে দেখা যায়, রিসোর্ট তো নয় সেটা যেন মিনি গবেষণাগার। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত বলে তাদের কাছ থেকে সময় পাওয়া গেল না। ওই ফাঁকে কথা হলো পুরো টিমের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক প্রফেসর ড. হোসেন জামাল স্যারের সঙ্গে। তিনি বলেন ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ সমুদ্র শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান হলো ‘ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সস অ্যান্ড ফিসারিজ’। সমুদ্রিক গবেষণায় অনেক অবদান আছে এই প্রতিষ্ঠানের। সব শিক্ষার্থীর উচিত প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষা গ্রহণের । প্রতিবছরই আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এখানে নিয়ে আসি।আবার আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখনো শিক্ষার উদ্দেশে আসতাম।’ তারপর উনি উনার সময় থেকে বর্তমান সময়ের সেন্ট মার্টিনের অবস্থা বর্ণনা করেন।
৯ ফেব্রুয়ারি, সকাল ৬টায় পুরো টিমের দেখা মিলল ফেরিঘাটের পাশে। সবাই ঠিক আগের নীল টি-শার্টে, চেহারায় সমুদ্রময় ছাপ। টি-শার্টের বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক ড. মোসলেম উদ্দীন মুন্না স্যারের সঙ্গে কথা বললে, উনি বলেন- ‘সমুদ্র নিয়ে পড়াশোনাটা আসলে পুরোপুরি চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। পৃথিবীর বড় অংশই জলমগ্ন। জলই আমাদের দিতে পারে সবকিছু।সময় পরিবর্তিত হচ্ছে, সঙ্গে বিশ্ব সমুদ্রের প্রয়োজনীয়তাটা বুঝতে পারছে। সমুদ্রের পানির রং স্বাভাবিকভাবে নীল। মূলত, টি-শার্টের নীল রঙের কারণ এটাই। আর সমুদ্রবিজ্ঞানিদের ক্লাসরুম সমুদ্র্রনির্ভর হওয়াটাই বাঞ্চনীয়।’
ফেরিওয়ালারা তখন ছুটছিল সমুদ্রতটের পানে। লক্ষ্য এখন পুরো আট কিলোমিটার দ্বীপ পরিদর্শন করে দেখবে কোথায় তার কী অবস্থিত। কথা বলছিল দ্বীপের মানুষজনের সঙ্গে, দ্বীপে আসা পর্যটকদের সঙ্গে। সবার হাতে আছে একটি স্ক্রেচিং করা সেন্ট মার্টিনের মানচিত্র।পাশেই গুটিকয়েক ফেরিওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে জোয়ারের তোড়ে ভেসে আসা সামুদ্রিক আগাছা((seaweeds)) সংগ্রহ করছেন সহযোগী অধ্যাপক মিসেস আয়েশা আক্তার। জানতে চাইলে তিনি বলেন- ’বর্তমান বিশ্বে এই ধরনের শৈবালের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে সেন্ট মার্টিনের মতো অনুকূল পরিবেশে কিছু কিছু ভিন্ন seaweed পাওয়া যায় যা কেবল এই পরিবেশেই মানানসই।’ এসব উদ্ভিদের বাহারি ব্যবহারের কথাও শুনালেন তিনি।
উত্তরপাড়া থেকে প্রায় ৪ ঘণ্টা হাটার পর দক্ষিণপাড়ায় গিয়ে দেখা মিলল দলের অপর অংশের সঙ্গে। রিসোর্টে গিয়ে দেখা পাওয়া গেল অধ্যাপক ড. আশরাফুল আজম স্যারের, তিনি ছাত্রদের প্রশ্ন করলেন, তোমাদের দেখে আসা বাতিঘরের গুরুত্ব কী?
পাশ থেকে ফেরিওলাদের একজনের উত্তর-‘রাতের সমুদ্রে চলাচল করা জাহাজগুলোকে দিক নির্দেশনা প্রদান করা এবং দ্বীপের অবস্থান শনাক্ত করা।’ ওই দিন বিকেলে দেখা গেল এদের ভিন্ন কাজ- একদল সাইক্লিংয়ে মগ্ন, একদল বিচের পাশে ফুটবল খেলছে, কজন মনের সুখে গান ধরেছে, একদল দ্বীপের মায়ায় ঘুরছে, আরেক দল কথা বলছে দ্বীপের সাধারণ মানুষের সঙ্গে, পর্যটকদের সঙ্গে এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে, অন্যদল দ্বীপ রক্ষার বার্তা দিচ্ছে সাধারণ লোকদের কাছে। আরো একটা দল ছিল যারা ছিন্ন দ্বীপ ছেড়াদিয়া থেকে ঘুরে আসছে। রাতে আবারও সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সংগৃহীত নির্দিষ্ট নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে।
স্যারদের কাছ থেকে শোনা যায়-সবাই ১০/০২/১৭-এর বিকেলের জাহাজে টেকনাফ ফিরবেন, তাই ওই দিন সকালেই সবার অংশগ্রহণে একটা মুক্ত আলোচনা হবে। ৯তারিখ সন্ধ্যা থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত রিসোর্টের রুমগুলো সরগরম ছিল সবার জাগরণে। তাদের ব্যস্ততা ছিল পোস্টার পেপারগুলো তৈরিকরণে। সকালে উঠে সবাই তাদের গ্রুপভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল প্রেজেন্টেশন করল। বেলঅ ২টায় সবার তড়িঘড়ি জাহাজে ফেরা। অবশেষে রাত ৯টায় সবাই কক্সবাজার ফিরল। এসে হোটেলে হলো এক জম্পেস সাংস্কৃতিক পর্ব, সঙ্গে ছিল সেন্ট মার্টিন নিয়ে মনোমুগ্ধকর বিতর্ক আয়োজন। এবার ফেরার পালা; ১১ফেব্রুয়ারি দুপুরে পুরো দলটি ফিরল আবার তাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে।
একঝাঁক তরুণ সমুদ্রসন্তানকে ধন্যবাদ দিলে ছোট হবে। তবে বাস্তবিকপক্ষে আমাদের সবার উচিত এই ভূমিকার অংশীদার হওয়া। নীল টি-শার্টওয়ালা ফেরিওয়ালাদের থেকে খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেল, আজো তারা ব্যস্ত পাঁচদিনের পুরো ট্রিপের রিপোর্ট তৈরিতে। আজীবনের জন্য বাঁচুক সেন্ট মার্টিন, দীর্ঘজীবী হোক নীল ফেরিওয়ালারা, সফলতা পাক তাদের সমুদ্রপ্রীতি।