অস্থির রাজনীতির কবলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, সেশন জটের আশঙ্কা
অস্থির ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক আন্দোলনে স্থবির হয়ে পড়ছে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি)। গত বছরজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ছিল অস্থির। আর চলতি বছরের শুরুতে শিক্ষকদের আন্দোলনে বন্ধ আছে পরীক্ষা। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ সেশনজটে পড়বে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
চলতি বছরের শুরুতেই দ্বিধাবিভক্ত শিক্ষক রাজনীতির জেরে অস্থির আছে ক্যাম্পাস। শিক্ষক সমিতির লাগাতার ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি দিয়েই শুরু হয়েছে বছরটি। আজ মঙ্গলবারও ক্লাস-পরীক্ষা চালুর দাবিতে বিক্ষোভ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষাবর্ষের একাডেমিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, নৃবিজ্ঞানের ২০১১-২০১২ শিক্ষাবর্ষের এখন স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ব্যাচটি গত ডিসেম্বরে স্নাতক শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষা সম্পূর্ণ করেছে। এ বিভাগের অন্যান্য ব্যাচের অবস্থা ঠিক একই রকম। ইংরেজি বিভাগের ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষের ব্যাচটির স্নাতকোত্তর পর্ব ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো চলছে। শিক্ষার্থীরা জানান, এ বিভাগের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিভাগে এ অবস্থা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ও কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলী (সিএসই) প্রকৌশল অনুষদের এ বিভাগ দুটির অবস্থা একই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯টি বিভাগের চিত্র আলাদা কিছু নয়। সেশন জটের গভীর জালে আটকা পড়ছেন শিক্ষকরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে চতুর্থ ব্যাচ থেকে ১০ ব্যাচ চলমান। কয়েক দিনের মাথায় শুরু হচ্ছে ১১তম ব্যাচের শিক্ষা যাত্রা। এ ক্ষেত্রে চতুর্থ ব্যাচ থেকে ১১তম ব্যাচ নিয়ে মোট ৭টি ব্যাচ অবস্থান করছে বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাভাবিকভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি ব্যাচের অবস্থান থাকার কথা ছিল।
নেপালের নাগরিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির শিক্ষার্থী মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন আন্দোলনের কারনে এখন আমার শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতির মুখে পড়েছে। দেশ থেকে আমার পরিবার যখন জানতে চায় পড়ালেখা শেষ করতে আর কত সময় লাগবে। তখন আমি সঠিক উত্তর দিতে পারি না।’ জাহাঙ্গীর চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ঠিক সময়ে একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রম চললে এখন জাহাঙ্গীরের স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার কথা।
জানা যায়, ২০১৩ সালে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে দেশের অস্থিতিশীল রাজনীতির কারনে দীর্ঘ সময়ে বিশ্ববিদ্যায়ের একাডেমিক কার্যক্রম গতিশীলতা হারায়। হরতালের কারণে নিরাপত্তার অভাবে ওই সময়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারেননি। একই বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের অস্থির রাজনীতির কারণে ক্লাস করতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। ২০১৩ সালে তৎকালীন উপাচার্য ড. আমীর হোসেনের শেষ বছর হওয়া শিক্ষক রাজনীতিতে দেখা যায় অস্থিরতা। উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে বেশ কয়েক দিন বন্ধ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির মোড় ঘুরলে আবারও কিছুটা স্থবিরতা আসে। সেকশন অফিসার জাকির হোসেন ওরফে প্রিন্সিপাল জাকিরের হাতে এক শিক্ষক লাঞ্ছিত হলে ঐ বছরের এপ্রিল মাসের প্রায় এক সপ্তাহ ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন শিক্ষকরা।
২০১৫ এর শুরুতে ২০ দলীয় জোটের হরতাল ও অবরোধের কারেন বেশ কয়েকদিন একাডেমিক কার্যক্রম ব্যহত হয়। কয়েক দফা সাক্ষাৎকার ও ভর্তি সময় পিছিয়ে ২০১৪-২০১৫ শিক্ষবর্ষের (৯ম) ব্যাচটির ক্লাসই শুরু হয় ২০১৫ এর ১৫ মার্চ। ২০১৫ তে এক ছাত্রলীগ নেতার গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে প্রায় দুই সপ্তাহ ছাত্র ধর্মঘট চললে আবারও স্থবির হয় ক্যাম্পাস। এর মাঝে বিভিন্ন সময় দরপত্রকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যে ও প্রভাব বিস্তার, দলীয় অন্তকোন্দল ও সংঘর্ষে প্রায়ই স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ হারায় বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৬ সালের ১ আগস্টের প্রথম প্রহরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তার ও হল দখলকে কেন্দ্র করে কাজী নজরুল ইসলাম হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিপনন বিভাগের ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ নিহত হন। ১ আগস্ট ৬২তম জরুরী সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্তে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের বন্ধ ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। টানা ৫৬ দিন বন্ধ থাকে ৬৩ তম সিন্ডিকেট সভায় সিন্ধান্ত নিয়ে খুলে দেওয়া হয় ক্যাম্পাস। তবে ক্যাম্পাস অভ্যন্তরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিলে নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলেও ১৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগকে সভা করা অনুমতি দিয়ে সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অমান্য করল খোদ প্রশাসন। খালিদ সাইফুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের দুই মাস ২৬ দিন পর গত ২৬ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখন পর্যন্ত কাউকে শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি।
সর্বশেষ শিক্ষকের বাসায় পরিকল্পিত হামলার রহস্য উদঘাটন ও বিচারের দাবিতে ২৪ ঘণ্টা সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ১৯ জানুয়ারি ক্লাস বর্জন করে শিক্ষক সমিতি। প্রশাসনে পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপের আশ্বাস না পেয়ে শিক্ষক লাঞ্ছনায় অভিযুক্ত ডিন এম এম শরীফুল করীমকে তদন্ত চলাকালীন সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া, বিভিন্ন ঘটনায় বিতর্কিত নবনিযুক্ত প্রক্টরকে সব ধরনের প্রশাসনিক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়াসহ মোট ছয় দফা দাবিতে ২২ জানুয়ারি রবিবার থেকে লাগাতার ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে আসছে শিক্ষক সমিতি।
এ তিনদিনের শিক্ষক সমিতির কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সর্বমোট ১১টি চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নুরুল করিম চৌধুরী জানান, মঙ্গলবার অর্থনীতি বিভাগের স্নাতকের একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সোমবার বিভিন্ন বিভাগের সেমিস্টারের চারটি ও বরিবার ৬টি চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. মো. আবু তাহের বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয় অস্থির থাকে। আর শিক্ষাবর্ষের জট নিরসনে শিক্ষকরা চেষ্টা করছেন। তবে শিক্ষকদের আন্দোলন যৌক্তিকভাবেই হচ্ছে। প্রশাসন আমাদের দাবি বিবেচনা করলেই আমরা ক্লাসে ফিরে যাব।’
শিক্ষাবর্ষের জটের বিষয়ে উপাচার্য ড. মো. আলী আশরাফ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জট নিরসনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ শিক্ষকদের আন্দোলনে বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট আইনে চলে। হুট করে তাদের অযৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া যায় না।’
এ দিকে ক্লাসে ফেরার দাবিতে টানা তিনদিন বিক্ষোভ করে আসছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবারও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সকালে ক্যাম্পাসের ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। গত রোববার মানববন্ধন করে ক্লাস ও পরীক্ষা চালুর দাবিসহ ১১ দফা দাবিতে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার ক্লাস চালুর দাবিতে তাঁরা ক্যাম্পাসের কাঁঠালতলায় ও ফটকের বাইরে বিক্ষোভ করেন।