তাঁদের ঘর নেই
শীতের আমেজে পিঠা বিক্রির খবর জানতেই গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায়। সেখানে কথায় কথায় বেরিয়ে এলো এই পিঠা বিক্রেতাদের জীবনের ভেতরের খবর। দিনশেষে যাঁদের অনেকেরই মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই এই বিশাল শহরে। অথচ বছরের পর বছর তাঁরা এই শহরেই রয়েছেন। রুটি-রুজির জন্য ফুটপাতে ছোটখাটো ব্যবসা করেই জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন এই মানুষগুলো।
এই মানুষগুলোর কেউ কেউ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আছেন এই শহরে। দিনের সূর্য নিভে গেলে পার্ক, রিকশা-ভ্যান, ফুটপাতে কাপড় টানিয়ে তৈরি করা ঘরই হয়ে ওঠে এই মানুষগুলোর রাতযাপনের ঠাঁই। গ্রামে ঘর (পরিবার) বাঁচানোর জন্য শহরে ঘর এড়িয়ে টাকা বাঁচান তাঁরা।
কথা হয় টিএসসি মোড়ের পিঠা বিক্রেতা আলাউদ্দিনের সঙ্গে। জীবিকার তাগিদে আজ থেকে পাঁচ বছর আগে রাজধানীতে আসেন চাঁদপুরের যুবক আলাউদ্দিন। এর পর থেকেই টিএসসি এলাকায় চটপটির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এখন মৌসুমি ব্যবসা হিসেবে শীতের পিঠা বিক্রি করছেন।
ঢাকায় কোথায় থাকেন জানতে চাইলে আলামিন বলেন, ‘এখানেই।’ এখানেই কোথায় জানতে চাইলে পার্ক দেখিয়ে দেন তিনি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে রাখা ‘চটপটির গাড়ি’ গাড়িই তাঁর বসবাসের জায়গা! ওটাই তাঁর ঘর!
এই এলাকার আরেক পিঠা বিক্রেতা কালু মিয়ার বাড়ি রংপুরে। প্রায় দেড় যুগ হলো ঢাকায় তিনি। করেন হরেক মালের ব্যবসা। তবে মৌসুম বুঝে বদলায় তাঁর ব্যবসাও। বর্তমানে চটপটি, শরবত, পিঠা বিক্রি করছেন।
মৌসুমভিত্তিক ব্যবসা বদলালেও কখনোই বদলায় না কালু মিয়ার জীবনযাপনের ধরন। তিনিও থাকেন পার্কে। দেড় যুগ পরও এই বিশাল শহরে তাঁর নিজস্ব মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হয়ে ওঠেনি। এমনকি ভাড়া বাসার একটি ছোট্ট খুপরিও জোগাড় করার সামর্থ্য হয়ে ওঠেনি তাঁর।
গ্রামের বাড়িতে পরিবারের সদস্যদের টাকা পাঠাতে হয়। পরিবারের খরচ চালাতে গিয়ে এখানে বাড়তি খরচ করার সুযোগ নেই তাঁর। ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকাটা আলাউদ্দিন, কালুদের কাছে ‘বাড়তি খরচ’ হিসেব গণ্য হয়।
শুধু আলাউদ্দিন, কালুই নয়, এ রকম হাজারো উদ্বাস্তু মানুষ আছেন এই শহরে। যাঁরা এভাবেই পার্ক, ফুটপাতে রাত্রিযাপন করে থাকেন। এটাই তাঁদের জীবনযাপনের নিত্যদিনকার চিত্র। হয়তো উদ্বাস্তু মানুষের জীবনবোধের উপলব্ধি থেকেই তরুণ কবি অভিজিৎ দাস তাঁর একটি গীতি কবিতায় বলেছেন, ‘ঘর নেই যার, আকাশটা তারই হোক’। আকাশমুখো হয়েই হয়তো বেঁচে থাকেন তাঁরা।