পহেলা বৈশাখে ক্যাম্পাসজুড়ে যৌন হেনস্তা!
‘প্রতিটা জায়গাতেই নারীদের লাঞ্ছিত করা হচ্ছিল। আমরা যতদূর সম্ভব তাঁদের উদ্ধার করছিলাম। একজন মহিলা বারবার বলছিলেন, তাঁর শিশু সাথে আছে। তাঁকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই শিশুটির সামনেই ওই মাকে লাঞ্ছিত করা হয়।’
বর্ষবরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী পার্কের গেটে নারীদের ওপর যৌন হেনস্তার ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দী। নারীদের ওপর যৌন হেনস্তার প্রতিবাদে আজ শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্র-শিক্ষক জনতার সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে এ সংহতি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে নারী নির্যাতনের বর্বরোচিত ঘটনার বর্ণনা করেন ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি লিটন নন্দী। তিনি বলেন, ‘১৪ এপ্রিল সমগ্র বাংলাদেশ যখন বৈশাখ উদযাপনে ব্যস্ত ছিল, তখন আমিও মেতে ছিলাম। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সিপিবি-বাসদ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন ভাইয়ের প্রচারপত্র বিলি করে টিএসসিতে আসি। তখন যানজটে টিএসসি এলাকা পুরো ব্লক ছিল।’
লিটন নন্দী বলেন, ‘সাড়ে ৫টার একটু পরে আমিসহ ছাত্র ইউনিয়নের চার নেতা-কর্মী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে জনস্রোতে গিয়ে দেখি, যুবকদের দুই থেকে তিনটা দল উদ্যানের দিকের গেটটা বন্ধ করে রেখেছে। সেখানে বিভিন্নভাবে নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে। আমরা তখন দুই হাত উঁচু করে করিডর বানিয়ে নারীদের বের করতে থাকি।’
লিটন নন্দী আরো বলেন, ‘এভাবে বের করতে করতে সোয়া ৬টার দিকে ভিড়ের ভেতর একজন নারীর চিৎকার শুনি। দৌড়ে গিয়ে মানুষরূপী হায়েনাদের দৃশ্য দেখি। এ দৃশ্য সভ্য ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ২৬-২৭ বছরের একজন নারী প্রায় বিবস্ত্র। তাঁর স্বামী তাঁকে জড়িয়ে ধরে আছেন। এরপর আমার গায়ে পরা এ পাঞ্জাবিটা খুলে তাঁর শরীর ঢেকে দেই। তখন ওই হায়েনার দল ওই পাঞ্জাবিও খুলে নেওয়ার চেষ্টা করে।’
লিটন নন্দী বলেন, ‘এই ন্যক্কারজনক হামলা চলার সময় মাত্র দুজন পুলিশ সোহরাওয়ার্দীর গেটে ছিলেন। আর কিছু পুলিশ সদস্য মিলন চত্বরে ছিলেন। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আমরা এভাবে হায়েনাদের প্রতিরোধ করতে থাকি। পুলিশরা এ সময় একেবারেই নিষ্ক্রিয় ছিল।’
লিটন আরো বলেন, ‘সাড়ে ৬টার দিকে ১৭-১৮ বছরের একটি মেয়ের জামাকাপড় ছেঁড়া হয়। আমি তখন প্রতিরোধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়ে যাই। তখন লাথি, কিল, ঘুষি আর পায়ের পাড়া আমার ওপর পড়ে। সে সময় ওই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমি তখন ওই হায়েনাদের উদ্দেশ্যে বলি- ভাই দয়া করে মেয়েটাকে মেরে ফেলেন না।’ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে বলে তিনি জানান।
লিটন নন্দী বলেন, ‘এই জায়গা থেকে বের হয়ে ৭টার একটু আগে-পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে ফোন করি আমি। তখন প্রক্টর জানান, সোহরাওয়ার্দীর গেট তো বন্ধ থাকার কথা।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রক্টর তখন তাঁর অফিসের কম্পিউটারে দাবা খেলায় মত্ত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি তখন ফোনে বলেন, আমি ওখানে গিয়েও কী করতে পারতাম! এই ঘটনার পর প্রক্টর বিভিন্ন জায়গায় এ ঘটনা সম্পর্কে দেওয়া বক্তব্যে পাঁচ মিনিট পরপর বক্তব্য বদলে ফেলেছেন।’
এ সময় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা সুমন সেনগুপ্ত ও অমিত দে। তাঁরাও সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন যৌন হেনস্তাকারীতে সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ক্ষমতার রোগে আক্রান্ত অসুস্থ কিছু লোকজন, অন্যকে নির্যাতন করে আনন্দ করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেমন খুনিদের রক্ষা করে, তেমনিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অপরাধীদের রক্ষায় কাজ করে।’ তিনি বলেন, ‘রাস্তায় মানুষ থাকবে কোনো দুর্বৃত্ত নয়।’
আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, ‘মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলে হবে না। বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।’
ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার বলেছেন, ‘দেশে যখন গণতন্ত্র থাকে না। তখন এর শিকার হয় নারী।’ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সংগীত শিল্পী সায়ান বলেন, ‘প্রতিবাদ করে লাভ হচ্ছে না। যাদের যে কাজ তারা সেট ঠিকভাবে করছেন না। তাতে এই ধরনের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে।’
সভায় প্রক্টরের অপসারণ, দায়ী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচার, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নসহ ছয় দফা দাবির কথা বলা হয়।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক রাজীব মীর, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি হাসান তারেক, সাধারণ সম্পাদক লাকী আক্তার, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদপ্রার্থী আবদুল্লাহ আল ক্বাফী, সাংবাদিক সুপ্রীতি ধর, সংগীতশিল্পী সায়ান, বিপ্লবী নারী সংহতির সমন্বয়ক শ্যামলী শীল প্রমুখ।