এমসিকিউ তুলে দেওয়ার প্রস্তাব শিক্ষাবিদদের
পরীক্ষায় বহু নির্বাচনী প্রশ্ন (এমসিকিউ) পদ্ধতির বাতিলের প্রস্তাব করেছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। একই সঙ্গে সৃজনশীল পদ্ধতি কার্যকর করতে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নব্যাংক তৈরি, শিক্ষা কারিকুলাম সহজ ও বোধগম্য করা, কোচিং ও গাইড বই বাণিজ্য বন্ধ এবং শিক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন তাঁরা।
আজ বৃহস্পতিবারর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বিশিষ্টজনরা সরকারের কাছে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এতে সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষাসচিব মো. সোহরাব হোসাইনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব চৌধুরী মুফাদ আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন।
বিশিষ্টজনদের মধ্যে ড. খলীকুজ্জামান, সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সাবেক গভর্নর ড. ফরাসউদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খায়রুজ্জামান, প্রকৌশলী রেজাউল করিম, ব্র্যাক কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ বক্তৃতা করেন।
ড খলীকুজ্জামান বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে এ খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। প্রতিবছরই শিক্ষা খাতের বাজেটে মোট টাকার অঙ্ক বৃদ্ধি পেলেও জিডিপির হারে তা আবার প্রতিনিয়ত কমছে। তিনি বলেন, গত বাজেটে শিক্ষা খাতে মোট জিডিপির ২ দশমিক ২ ভাগ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। চলতি বাজেটে ১ দশমিক ৮ ভাগ এবং শোনা যাচ্ছে আসন্ন আগামী বাজেটেও এ খাতে বরাদ্দ জিডিপির হার অনুযায়ী আগের চেয়ে বাড়ছে না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বাজেট বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, এভাবে আলোচনা করে শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। বরং এ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করে, সে কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব ও সহজতর হবে বলে তিনি মনে করেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এ প্রতিষ্ঠাতা বলেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে সৃজনশীল পদ্ধতিকে কার্যকর করতে হলে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নব্যাংক তৈরি করতে হবে।
শিক্ষকরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারছেন না উল্লেখ করে আবু সায়ীদ বলেন, এ জন্য এ পদ্ধতির সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতি বিষয়ে এক হাজার করে প্রশ্ন তৈরি করে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। প্রয়োজনে নেটে তা ছেড়ে দিতে হবে। তাহলে কোচিং বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের দৌরাত্ম্যও কমে আসবে।
এমসিকিউ পদ্ধতির পরীক্ষা ১৫ নম্বরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়ে অধ্যাপক সায়ীদ বলেন, ‘পরীক্ষা হলো ফেল করানোর জন্য। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন যে হারে পাস করছে, তাতে মানুষের মনে সন্দেহ জাগছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে পরীক্ষা পদ্ধতিতে আরো কঠোরতা আরোপ করতে হবে।’ সেই সঙ্গে তিনি স্কুলগুলোতে ছোট আকারে হলেও লাইব্রেরি চালু করার প্রস্তাব দেন।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, নবম শ্রেণীর সায়েন্স বই পড়ে তিনি নিজেই অনেক কিছু বুঝতে পারেন না। একজন শিক্ষার্থী তা কীভাবে বুঝবে? তাই তিনি মাধ্যমিক শিক্ষার কারিকুলাম সহজ ও বোধগম্য করার প্রস্তাব করেন। প্রয়োজনে নতুন করে কারিকুলাম তৈরিরও প্রস্তাব রাখেন। শিক্ষার মানোন্নয়নে গাইড বই নিষিদ্ধ এবং এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করে তিনি পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরিতে আরো দক্ষ শিক্ষকদের দায়িত্ব দেওয়ার পরামর্শ দেন।
অধ্যাপক খায়রুজ্জামান বলেন, পরীক্ষা হলো ছাকনি, অর্থাৎ ভালোটি বেছে নেওয়া। তাই বর্তমানের মতো আমরা যদি সবাইকেই পাস করাই তাহলে পরীক্ষার তো প্রয়োজন নেই। তিনি সৃজনশীল পদ্ধতি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করে বলেন, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতি থাকার দরকার নেই, বরং প্রয়োজন বেসিক বিষয় শিক্ষা দেওয়া।
রাশেদা কে চৌধুরী এমসিকিউ পদ্ধতি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করে বলেন, কোয়ালিটি যেন কোয়ানটিটির সাথে কম্প্রমাইজ না করে। তিনি সরকারের বিনামূল্যে বিতরণকৃত বইয়ের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা নিজেদের লেখা বই শিক্ষার্থীদের কিনতে ও পড়তে বাধ্য করাচ্ছেন, এ বিষয়টি বন্ধের দাবি জানান।
বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা তরুণদের চ্যালেঞ্জ করতে পারছে না উল্লেখ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক কায়কোবাদ বলেন, এমন চমৎকার কারিকুলাম ও চমৎকার প্রশ্নপত্র তৈরি করতে হবে, যা তরুণদের পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে এবং তারা যেন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হয়। ১০-১৫ বছরের মধ্যে যেন কারিকুলামে আর হাত দিতে না হয় তেমনি যুগোপযোগী কারিকুলাম তৈরি করার প্রস্তাব তিনি দেন।
সুলতানা কামাল বলেন, মানসম্মত শিক্ষা পেতে হলে মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আর তার জন্য শিক্ষায় ব্যয় বাড়াতে হবে।
ড. ফরাসউদ্দীন টেক্সট বুক ও গাইড বই এক সাথে চলতে পারে না উল্লেখ করে বলেন, পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা প্রথমে বাহবা কুড়ালেও এখন এ পরীক্ষা দু’টি রমরমা কোচিং ব্যবসা সৃষ্টি করে চলেছে। সরকারি উদ্যোগে তিনি কওমি মাদরাসায় বৃত্তিমূলক শিক্ষা চালুর প্রস্তাব করেন।
শিক্ষামন্ত্রী সবার বক্তব্য শুনে বলেন ‘আপনাদের পরামর্শ, সুপারিশ ও প্রস্তাব সবই নোট করে, এমনকি অডিও-ভিডিও করে নেওয়া হয়েছে।’ একটি কমিটি গঠন করে বিশিষ্টজনদের দেওয়া এ পরামর্শগুলো নিয়ে তারা বসবেন এবং তা যাচাই-বাছাই করে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হবেন বলেও তিনি জানান।
নাহিদ বলেন, যাতে ১৫ বছর চলে এমন চমৎকার ও আনন্দময় পাঠ্যপুস্তক তৈরির জন্য নতুন কারিকুলামের প্রস্তাবটি তাঁরা ভেবে দেখবেন।
১০ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য এখনো সরকারের বেশ কয়েকটি প্রজেক্ট কাজ করছে।
শিক্ষক ও বিশিষ্টজনদের পরামর্শেই সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রশ্নব্যাংক তৈরির বিষয়টিও ভেবে দেখা হবে। তিনি বলেন, শিক্ষাকে মানসম্মত করতে ২০১৭ সাল থেকে এমসিকিউর ১০ নম্বর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এমসিকিউ পরীক্ষাটি শুরুতে নিয়ে আসা হয়েছে।
সরকার কোচিং বাণিজ্য ও গাইড বইয়ের বিরোধী উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীরা মূল বই পড়বে এবং শিক্ষকরাই তা পড়াবেন। এ বিষয়ে আরো কঠোরতা আরোপ করা হবে বলেও তিনি জানান।