রাবি অধ্যাপক রেজাউল হত্যা : আরো ২ জন আটক
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের কোনো রহস্য এখনো উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। তবে অধ্যাপক সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে পারে বলে আপাতত ধারণা করছে পুলিশ।
আজ শুক্রবার ভোরেও বাগমারা থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুলশিক্ষক ও তাঁর কলেজ পড়ুয়া ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।
বিকেলে রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কার্যালয়ে রাজশাহীর সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে র্যাবসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন।
বৈঠক শেষে আরএমপি কমিশনার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকালের আলোয় প্রকাশ্যে অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনা অনেকেই দেখেছে। কিন্তু কোনো প্রত্যক্ষদর্শী আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে আসছে না।’
তথ্য দিয়ে অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে প্রত্যক্ষদর্শীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বলেন, তাঁদের পরিচয় গোপন রাখা হবে।
মো. শামসুদ্দিন বলেন, অধ্যাপক সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের তথ্য উদঘাটনের জন্য শুক্রবার সকালে বাগমারা থেকে দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে তদন্তের স্বার্থে তিনি তাঁদের বিস্তারিত পরিচয় জানাতে রাজি হননি।
আরএমপি কমিশনার বলেন, এর আগে নগরী থেকে আটক ছাত্রশিবির নেতা হাফিজুর রহমান, যিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাঁকে গত বৃহস্পতিবার চারদিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে অধ্যাপক সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া নগরীর মতিহার থেকে ছাত্রশিবিরকর্মী খায়রুল ইসলাম এবং বাগমারা থেকে মসজিদের ইমাম রায়হান আলীকে আটক করা হয়েছে। তাঁদেরও রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আগামী সোমবার তাঁদের রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।
পুলিশ কমিশনার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহীতে অধ্যাপক সিদ্দিকী, হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্র ও এক ছাত্রীর লাশ উদ্ধার, জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক জিয়াউল হক টুকু এবং সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বোমা ফাটিয়ে নগরীতে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতির ঘটনাগুলোর মধ্যে অধ্যাপক সিদ্দিকীর হত্যাকাণ্ডটি সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
গ্রামের বাড়িতে গানের স্কুল প্রতিষ্ঠাকেন্দ্রিক বিরোধ কিংবা গ্রাম্য কোনো বিরোধকে কেন্দ্র করে অধ্যাপক সিদ্দিকী খুন হয়েছেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন বলেন, এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের নির্দিষ্ট রহস্য উদঘাটন করা যায়নি। গ্রাম্য বিরোধসহ সম্ভাব্য সব কারণগুলোই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
এদিকে পুলিশ কমিশনার পরিচয় জানাতে না চাইলেও শুক্রবার সকালে অধ্যাপক সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ির এলাকা থেকে যে দুজনকে আটক করা হয়েছে স্থানীয়ভাবে তাঁদের পরিচয় জানা গেছে। এঁরা হলেন বাগমারা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আবদুল হাকিম (৬৩) ও তাঁর ছেলে বাগমারা কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আরিফুল ইসলাম। তাঁদের বাড়ি বাগমারার শ্রীপুর গ্রামে।
আবদুল হাকিমের ছোট ভাই ইসাহাক আলী জানান, শুক্রবার ভোরে তাঁর ভাই আবদুল হাকিম ফজরের নামাজ পড়ার জন্য বাড়ির পাশের মসজিদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ১৫-১৬ জনের একদল লোক বাড়িতে ঢোকে। তাঁরা আবদুল হাকিম (৬৩) ও তাঁর ছোট ছেলে আরিফুল ইসলামকে (১৮) ঘুম থেকে ডেকে তুলে নিয়ে যান। এ সময় তাঁরা বাড়ির সবার মুঠোফোনও জব্দ করে নিয়ে গেছেন।
ইসাহাক আলীর ধারণা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউল করিম সিদ্দিকী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁদের নেওয়া হতে পারে।
বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতিয়ার রহমান জানান, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। বাগমারা থানার পুলিশ তাঁদের আটক করেনি।
এদিকে, অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর গ্রামে কারো সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল কি না, তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে পুলিশ। অধ্যাপক রেজাউলের নিজ গ্রামে খাসপুকুরকে ঘিরে ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক এক কাউন্সিলের রেষারেষি ছিল বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অধ্যাপক সিদ্দিকীর নিজ গ্রাম দরগামাড়িয়ার চারটি খাসপুকুর জালিয়াতির মাধ্যমে ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও দরগামাড়িয়া গ্রামের পাশের খাজাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান মজনু নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নেন। এতে তাঁর সঙ্গে গ্রামবাসীর বিরোধ সৃষ্টি হয়। পুকুর চারটির মধ্যে একটির কিছু অংশ অধ্যাপক সিদ্দিকীর মালিকানায় ছিল। অধ্যাপক সিদ্দিকী খুন হওয়ার পর থেকে মজনু গা ঢাকা দিয়েছেন। তিনি কোথায় আছেন, তা জানাতে পারেনি পরিবারের কোনো সদস্য। তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও বর্তমানে বন্ধ আছে।
নিহত অধ্যাপক সিদ্দিকীর ছোট ভাই সিরাজুল করিম সিদ্দিকী জানান, পুকুর নিয়ে মামলা চলছিল। এ বিষয়ে তাঁর ভাই মাঝেমধ্যে আদালতে গিয়ে খোঁজখবর নিতেন। তবে তাঁকে হত্যার পেছনে এটি কারণ কি না, সে সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই।
ভবানীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল মালেক মণ্ডল বলেন, খাসপুকুর নিয়ে মজনুর জালিয়াতির বিষয় প্রকাশ পাওয়ার পর গ্রামবাসীর পক্ষে আদালতে গিয়ে বিষয়টির খোঁজখবর নেওয়ার জন্য অধ্যাপক সিদ্দিকীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
খাজাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন জানান, তিনি নিজ গ্রামের পক্ষে এবং অধ্যাপক সিদ্দিকী দরগামাড়িয়া গ্রামের পক্ষে আদালতে গিয়ে মামলার খোঁজখবর নিতেন এবং তদবির করতেন। এতে মজুন তাঁর এবং অধ্যাপক সিদ্দিকীর প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন।
অধ্যাপক সিদ্দিকী হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রেজাউল সাদিক বলেন, তদন্তে ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং গ্রাম্য বিরোধকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
গত ২৩ এপ্রিল সকালে রাজশাহী নগরীর শালবাগান এলাকার বাসা থেকে নাশতা করে ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে বাসার পাশেই দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। এ ঘটনায় ওই দিনই অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে বোয়ালিয়া মডেল থানায় হত্যা মামলা করেছেন তাঁর ছেলে। মামলাটি বর্তমানে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।