যেভাবে রাজশাহীর সোনার দোকানে ডাকাতি
রাজশাহী মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা গণকপাড়ায় সন্ধ্যারাতে বোমা ফাটিয়ে এম রায় জুয়েলার্সে ডাকাতির ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখনো পুলিশ এর কোনো সুরাহা করতে পারেরি। এ ঘটনায় আটক হয়নি কেউ। উদ্ধার হয়নি ডাকাতির প্রায় কোটি টাকার স্বর্ণালংকারও।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ৮টার দিকে জুয়েলার্সে সংঘটিত ডাকাতির ঘটনা নিয়ে এখনো ওই এলাকা এবং আশপাশের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফিল্মি স্টাইলে ঘটানো এমন ডাকাতির ঘটনা এর আগে কখনো দেখেনি নগরীর বাসিন্দারা।
ডাকাতির এই ঘটনার পর মহানগর পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। নগরীর প্রাণকেন্দ্র গণকপাড়া এলাকায় প্রায় সব সময়ই পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের আনাগোনা থাকে। ঘটনাস্থলের ১০০ গজ দূরে জিরো পয়েন্টে রাত-দিন পুলিশের টহল থাকে।
ঘটনাস্থলের পশ্চিম দিকে মাত্র ১০০ গজ দূরেই মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি। এরপরও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যারাতে ঘটে যাওয়া ডাকাতি প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারেনি পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৫-২০ জনের ডাকাতদল চলে যাওয়ার পর পুলিশ পাঁচটি ফাঁকা রাবার বুলেট ছুড়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে।
আলোচিত এই ডাকাতির ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল, এ বিষয়টি জানতে কথা হয় প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের সঙ্গে।
এদের মধ্যে এম রায় জুয়েলার্সের কর্মচারী বিপুল জানান, কেবল সন্ধ্যা শেষ হয়ে রাত শুরু হয়েছে। দোকানে তখনো নারী কাস্টমার সাতজন। তাঁরা কেউ অর্ডারের গহনা নিতে এসেছেন, কেউ আবার নতুন করে গহনার অর্ডার দিতে এসেছেন। তিনি তখন বসেছিলেন দোকানের এক কোণায়। ক্যাশ বাক্সে ছিলেন মালিক মনিশ রায়। এমন সময় কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকজন ব্যক্তি অস্ত্র হাতে দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ে। অস্ত্রধারীদের একজন মালিকের হাতে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ বসায়। এরপর আরেকজন বন্দুক তাক করে মালিকের দিকে। নিচে বসে থাকা কর্মচারী বিপুলের সামনে গিয়ে কয়েকজন বলে, ‘ওপরের দিকে মুখ তুলবি না। মেরে ফেলব।’ এরই মধ্যে ডাকাতদলের অন্য সদস্যরা শুরু করে লুটপাট।
বিপুল আরো জানান, দোকানের সিন্দুকে রাখা সোনার গহনা থেকে শুরু করে সামনে যতগুলো গহনা তারা পেয়েছে, সব গহনাই তারা লুট করতে থাকে। দোকানের ক্রেতারা তখন আতঙ্কে যে যারমতো পালাতে ব্যস্ত।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় আদিলুর রহমান বলেন, ভেতরে একদল ডাকাত লুটপাটে ব্যস্ত। আর বাইরে পাহারা দেওয়া ডাকাতরা একের পর এক ককটেল-বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। বোমার আওয়াজ ও ধোঁয়ায় তখন আশপাশ প্রায় অন্ধকার। মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। এরই মধ্যে বোমার আঘাতে পাশের দোকানের ব্যবসায়ীসহ কয়েকজন পথচারী ও একজন ভ্যানচালকও আহত হন।
আহত শফিকুল ইসলাম নামের একজন বলেন, তখন আতঙ্কিত আশপাশের মানুষ দিশেহারা। কেউ ভয়ে চিৎকার করার সাহস পর্যন্ত পাচ্ছে না। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেউ টের পাচ্ছে না পাশেই সোনার দোকানে ডাকাতি হচ্ছে। সবাই মনে করছেন জামায়াত-শিবির কর্মীরা হয়তো মিছিল থেকে বোমা বিস্ফোরণ করছে। তাই ওদিকে কেউ এগুচ্ছে না। ভয়ে সবাই যে যারমতো করে পালাতে ব্যস্ত।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনাস্থল থেকে খুব কাছেই নগরীর মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি। গণকপাড়া এম রায় জুয়েলার্স থেকে পুলিশ ফাঁড়ির দূরুত্ব খুব জোর ১০০ গজ। পায়ে হেঁটে মাত্র এক মিনিটের পথ। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণের শব্দ পেয়েও আসেনি পুলিশ। এই সুযোগে ডাকাতেরা ১০-১২ মিনিট ধরে এম রায় জুয়েলার্সে ডাকাতি করে প্রায় কোটি টাকার সোনার মালামাল লুটে নির্বিঘ্নে যে যারমতো করে চলে যায়। একটি দল যায় জুয়েলার্সের পাশের দোকানের গলির মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে। অন্যরা সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস এবং একটি মোটরসাইকেলে বিভিন্ন দিকে চলে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী মেহেদী নামের একজন জানান, তিনি তখন সাহেববাজার থেকে বাজার করে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় গণকপাড়া এলাকায় কয়েকটি বোমার আওয়াজ শুনে আতঙ্কে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন। তখন দেখতে পান, একটি মাইক্রোবাস নিউমার্কেটের দিকে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় মাইক্রোবাসটি থেকে পর পর কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় রাস্তার মানুষ আতঙ্কিত হয়ে দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করে।
বোয়ালিয়া মডেল থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার গোলাম সাকলায়েন বলেন, একদম পিক আওয়ার তখন। এই সময়ে এত বড় ডাকাতির ঘটনা ঘটবে, ভাবাই যায় না। তারপরও জনবহুল একটা স্থানে একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। ফলে সাধারণ মানুষ কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি মনে হয়।
মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শামসুদ্দিন জানান, ডাকাতরা মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ততক্ষণে পুলিশ এসে উপস্থিত হওয়ায় ডাকাতরা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য মানতে নারাজ। তাদের দাবি, পুলিশ এসেছে ডাকাতেরা নির্বিঘ্নে চলে যাওয়ার পর।
এম রায় জুয়েলার্সের পাশের দোকানের ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন, ‘এমন দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা এর আগে কখনো রাজশাহীতে ঘটেনি। এর আগে শুধু মিডিয়াতেই এমন ডাকাতির খবর পেতাম। আর এবার স্বচোখেই দেখলাম।’