আ.লীগ নেতার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পায় না পুলিশ
চেক প্রতারণার একটি মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাকে ছয় মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এ রায় দেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ, তৃতীয় আদালত। রায়ে গ্রেপ্তানি পরোয়ানা ইস্যু করার আদেশও দেওয়া হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর খুলনায় মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে ওই নেতার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়। কিন্তু পুলিশ বলছে, এ ধরনের কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তারা পায়নি।
দণ্ডাদেশ পাওয়া সাইফুল ইসলাম খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। একই সঙ্গে তিনি খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি ও খুলনা বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব।
দণ্ডাদেশ পাওয়ার পরেও সাইফুল ইসলাম প্রকাশ্যে কাজ করছেন, ব্যবসা দেখছেন, এমনকি আওয়ামী লীগের বৈঠকেও অংশ নিচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার কারণেই আইন-আদালতের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন সাইফুল।
চট্টগ্রামে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ, তৃতীয় আদালতের বিচারক মো. জামিউল হায়দার গত ১৩ সেপ্টেম্বর ডবলমুরিং থানার একটি মামলার রায়ে ‘মামলার পলাতক আসামি’ মো. সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দ্য নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর ১৩৮ ধারার বিধানমতে, অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে (সাইফুল ইসলাম) ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডাদেশ ও ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে আরো বলা হয়, পলাতক আসামি মো. সাইফুল ইসলাম আদালতে আত্মসমর্পণ বা পুলিশ কর্তৃক ধৃত হওয়ার তারিখ থেকে আসামির সাজার মেয়াদ গণনা শুরু হবে। পলাতক আসামি মো. সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ সাজা পরোয়ানা ইস্যু করা হোক।
রায়ে আরো বলা হয়, ‘অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অত্র রায়ের অনুলিপি বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, চট্টগ্রাম ও বিজ্ঞ মুখ্য মহানগর হাকিম বরাবরে প্রেরণ করা হোক।
ওই রায়ের বুনিয়াদে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ স্মারক নম্বর ৮৯৬৫, তারিখ ১৬.০৯.২০১৫, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়।
মামলায় আসামি হিসেবে ঠিকানা দেওয়া আছে মো. সাইফুল ইসলাম, মালিক এমভি আমিনুল ইসলাম নামক জাহাজ প্রতিষ্ঠান মেসার্স নয়ন এন্টারপ্রাইজ, ৯ এসি মার্কেট ডাকবাংলো খুলনা এবং মাতৃছায়া, পূর্ব বানিয়া খামার মেইন রোড় ,খুলনা সদর থানা।
এ ব্যাপারে খুলনা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি সাউথ জোনের আওতাভুক্ত। ডিসি সাউথ স্যার ভালো বলতে পারবেন।’
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপকমিশনার (দক্ষিণ) জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এই ধরনের কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এসেছে কি না তা কেউ তাঁর নোটিশে আনেননি। তাই তিনি কিছু বলতে পারবেন না।
খুলনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুকুমার বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাঁর থানায় এখনো আসেনি। তিনি জানান, এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কেএমপিতে আসবে। তারপর মহানগর হাকিম আদালত হয়ে তাঁদের থানায় আসবে।
এ ব্যাপারে খুলনা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রজব আলী সরদার বলেন, ‘সাজার রায় ঘোষণার পর আত্মসমর্পণ বা রায় উচ্চ আদালতে স্থগিত ছাড়া প্রকাশ্যে চলাচল সঠিক নয়। বিষয়টিতে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে।’ তিনি বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলা উচিত।
ওই মামলার বাদী চট্টগ্রামের সেলিম নবী সওদাগর বলেন, ‘রায় ঘোষণার পর ১৬ সেপ্টেম্বর সিএমপি ৮৯৫৬ নম্বর স্মারকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা খুলনায় প্রেরণ করেছে। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তা তামিল না হওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।’
সেলিম জানান, এই রায় ঘোষণা ছাড়াও আরো একটি মামলায় সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও মালামাল ক্রোকের আদেশ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘রায় বলবৎ থাকার পর প্রকাশ্যে প্রশাসনের সঙ্গে ওঠাবসা আইনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর শামিল।’
সাজা রায় ঘোষণার পর সাইফুল ইসলাম দলীয় এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। তিনি প্রকাশ্যে সভা, সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলনেও অংশ নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স ফি বর্ধিত বাতিলের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। গত ৭ অক্টোবর একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে জেলা প্রশাসকের দপ্তরে স্মারকলিপিও দেন তিনি। এ ছবি গত ৮ অক্টোবর খুলনার স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এ ব্যাপরে মহানগর বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক শামছুজ্জামান চঞ্চল স্বাক্ষরিত সম্প্রতি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘শুধুমাত্র বিরোধী দল করার কারণে যেখানে খুলনা মহানগর বিএনপির পাঁচ থানার বিএনপি ও অঙ্গ দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর নামে কোনো কারণ ছাড়াই ৬৪টি মিথ্যা মামলায় কোনো তদন্ত ছাড়াই তড়িঘড়ি করে শতাধিক অভিযোগপত্র প্রদান করে ঘরবাড়ি ও এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম মঞ্জু ও ৬২ হাজার ভোটে নির্বাচিত মেয়র মনিরুজ্জামান মনিসহ বিএনপির সিনিয়র থেকে শুরু করে মাঝারি ও ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মীদের আসামি করাসহ শত শত নেতা-কর্মীকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে। সেখানে ছয় মাসের সাজাপ্রাপ্ত আসামি খুলনা সদর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করছেন। এতেই প্রমাণিত হয় দেশে আইনের শাসন নেই ও প্রশাসন কোনো প্রকারেই নিরপেক্ষ নয়।
এ ব্যাপারে সাইফুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন।