কিশোরগঞ্জে ১৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ, দুই আসামির স্বীকারোক্তি
ভূমি অধিগ্রহণের ১৪ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় গ্রেপ্তার কিশোরগঞ্জ জেলা হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের নিরীক্ষক মো. সহিদুজ্জামান ও অফিস সহায়ক মো. দুলাল মিয়া তিনদিনের রিমান্ড শেষে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তাঁরা টাকা আত্মসাতের ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুই আসামি আজ বুধবার বিকেলে বিচারিক হাকিম আদালত ৪-এর বিচারক তছলিমা আক্তারের খাস কামরায় জবানবন্দি দেন। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে বিচারকের নির্দেশে দুজনকে কিশোরগঞ্জ কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর আগে মামলার শুরু থেকে দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় ময়মনসিংহ অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন।
কিশোরগঞ্জ জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দি প্রদান ও তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, গত ৬ ফেব্রুয়ারি নিরীক্ষক ও অফিস সহায়ককে হিসাবরক্ষণ কার্যালয় থেকে আটকের পর ১১ ফেব্রুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেকের তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আদালতের একটি সূত্র জানান, নিরীক্ষক মো. সহিদুজ্জামান জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ ডিসেম্বর জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম তাঁর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে বিল পাস করে তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে দিতে বলেন। এ সময় সেখানে জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছাড়াও একই কার্যালয়ের সুপার গোলাম হায়দার ভূঞা এবং মূল অভিযুক্ত সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) মো. সেতাফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার কথা মতো সহিদুজ্জামান তখন তাঁদের সামনেই বিল পাস করে দেন। এরপর প্রথমে হিসাবরক্ষণ কার্যালয়ের সুপার গোলাম হায়দার ভূঞা ও পরে জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম স্বাক্ষর করে সেতাফুল ইসলামের হাতে চেক দেন।
অপর আসামি অফিস সহায়ক মো. দুলাল মিয়া চেক প্রদানের পর সেতাফুল ইসলামের ব্যাংকে যাওয়া-আসা এবং টাকা উত্তোলন করে নিয়ে আসার ব্যাপারে খুঁটিনাটি বর্ণনা দেন।
পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে সেতাফুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিতে মো. সহিদুজ্জামান আত্মসাতের টাকার অংশ হিসেবে পাঁচ লাখ ও মো. দুলাল মিয়া এক লাখ টাকা পেয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। এ কথার সূত্র ধরে ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে আসা দুদকের একটি উচ্চ পর্যায়ের টিম কাগজপত্র পরীক্ষাসহ অনেককেই ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টি নিশ্চিত হয় এবং তাঁদের দুজনকে আটক করে।
ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি তহবিলের ১৪ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সেতাফুল ইসলাম গত ১৭ জানুয়ারি পিরোজপুর থেকে গ্রেপ্তার হন। পরে গত ২৯ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ জেলার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হলে বিচারক আ. ছালাম খান সেতাফুল ইসলামকে জিজ্ঞসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে ১৭ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশনের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ময়মনসিংহ অঞ্চলের সহকারী পরিচালক রাম প্রসাদ মণ্ডল বাদী হয়ে সেতাফুলকে একমাত্র আসামি করে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় সেতাফুলের বিরুদ্ধে জাল দলিল সম্পাদনের মাধ্যমে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। কিশোরগঞ্জ থেকে বদলির পর তিনি একই পদে পিরোজপুর জেলায় দায়িত্বরত ছিলেন। সেতাফুল ইসলামের বাড়ি ঢাকার ডেমরা থানার পূর্ব ডগাইর এলাকায়।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জন্য কিশোরগঞ্জে কয়েক শ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। এসব ভূমির মালিককে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার সময় জালিয়াতির আশ্রয় নেন সেতাফুল ইসলাম। জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল থেকে চেকের মধ্যে সেতাফুল ইসলাম পাঁচ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এ ছাড়া ঘটনা জানতে পেরে শেষ মুহূর্তে আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় থাকা আরো নয় কোটি টাকার চেক জব্দ করে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন ছাড়াও ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মির্জা তারিক হিকমতকে প্রধান করে আরেকটি এক সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ভূমি মন্ত্রণালয়। সব কটি কমিটি এরই মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।