নদ-নদীতে অবৈধ ঘের, মাছ ধরতে বাধা
কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও কুলিয়ারচরের মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, কালীসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রভাবশালীরা অবৈধ মাছের ঘের দিয়ে তাদের দখলে নিয়েছে।
‘জাল যার, জলাশয় তার’-সরকারের এই উদার মৎস্য নীতি আইন লঙ্ঘন করে জেলে সম্প্রদায়ের লোকজনকে মাছ শিকারে বাধা দিচ্ছে। এমন কি জোরজবরদস্তিসহ মারধর এবং নৌকা ও জাল ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। ফলে স্থানীয় কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পরিবার প্রয়োজনীয় মাছ শিকার করতে না পেরে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যদিকে নৌপথে এইসব প্রতিবন্ধকতার ফলে নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। নৌযান চালকসহ যাত্রীদের নানাভাবে হয়রারি করছে বলেও অভিযোগ নৌযান সংশ্লিষ্টদের। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভাটি এলাকার প্রবেশমুখ বলে খ্যাত ভৈরব পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, মেঘনা নদী এবং কুলিয়ারচরের কালী নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদী দিয়ে ঘেরা। এখানকার বিশাল জলরাশিতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন হয় মিঠাপানির সুস্বাদু নানা প্রজাতির মাছ। আর এই মাছ শিকারকে জীবিকা করে সুপ্রাচীনকাল থেকে এখানে মৎস্যজীবীদের বসবাস। এক সময় নদীতে মাছ শিকার করে তাদের জীবন-জীবিকায় ছিল সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু আজ সেইদিন সুদূর অতীত।
সাম্প্রতিককালে এলাকার কিছু প্রভাবশালীমহল এইসব নদ-নদীর বিভিন্ন স্থানে বাঁশের ঘের দিয়ে নিজেদের দখলে নিয়েছে। শুধু ঘের এলাকা নয়, জেলেদের মাছ শিকারে বাধা দেওয়া হচ্ছে ঘেরের আশপাশের এলাকায়ও। এতে প্রয়োজনীয় মাছ শিকার না করতে পেরে জেলে পরিবারগুলো দিন দিন দরিদ্রতার চরমসীমায় বসবাসে বাধ্য হচ্ছে।
অপরদিকে সরকারিভাবে দেওয়া জেলেকার্ড নিয়েও অভিযোগ রয়েছে জেলেদের। দুই থেকে আড়াই বছর আগে জেলেকার্ড পেলেও, তারা সরকারি কোনো সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে জানিয়েছে। আবার অনেক প্রকৃত জেলে উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ে ছোটাছুটি করেও তাদের জেলেকার্ড এখনো পায়নি। এসব অভিযোগ ভৈরবের জেলে আবদুস সালাম, সুনীল দাস, বিমল বর্মণ আর কুলিয়াচরের নীলেশ চন্দ্র দাস, সুখেন দাসের।
এদিকে জেলে সম্প্রদায়ের সুখ-দুঃখ দেখার কেউ নেই-এমন অভিযোগ করে জেলেদের নেতা, ভৈরব মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি কৃষ্ণ চন্দ্র দাস জানান, প্রতাপশালী ওই সব লোকজনের অত্যাচারের বিষয়ে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করে কখনো কোনো সুবিচার তাঁরা পাননি। তাদের ঘের বা খেওয়ের কারণে বছর বছর পলি জমে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বছরের দুই মাসের মতো সময় জেলেরা মাছ শিকার করার সামান্য সুযোগ পেলেও, ১০ মাসই থাকে ঘের মালিকদের দখলে।
নদীপথের এই মাছের ঘের যে কেবল মৎস্যজীবীদের রুটি-রোজগারের বাধা হয়েছে তাই নয়, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে নৌযান চলাচলেও। নদীর স্রোতমুখে ঘের দেওয়া, জাল পাতাসহ সব রকমের প্রতিবন্ধকতা তৈরি আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর এই কাজটি করে যাচ্ছে ওই প্রভাবশালী মহলটি।
ভৈরব থেকে নদীপথে সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী প্রভৃতি এলাকায় যাওয়ার পথে এইসব মাছের ঘের নৌযান চলাচলে বাধার সৃষ্টি করছে। নদীর মূলগতি পথে এইসব প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রায় যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযানগুলোকে খুব সাবধানে ও ধীরগতিতে চলাচল করতে হয়। এতে গন্তব্যে পৌঁছাতে নৌযানগুলোকে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে হয়। ফলে যাত্রীরা অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ভোগের শিকার হন।
অন্যদিকে নৌযান চলাচলের সময় কখনো যদি অসাবধানতায় ঘের বা পেতে রাখা জালে নৌযানের পাখা আটকে যায়, তখন ঘের মালিকরা নৌযান আটকে জরিমানা আদায় করে। আটকে থাকা নৌযানের যাত্রীদের নানাভাবে হয়রানি ও লাঞ্ছিত করে বলে অভিযোগ করেন লঞ্চচালক (মাস্টার) গোপাল চন্দ্র দাস ও লঞ্চমালিক মো. কাঞ্চন মিয়া। তাঁরা দ্রুত এই সমস্যার সমাধানও চান সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে।
চলমান নদীপথে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা নৌযান আইনে অপরাধ বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা, ভৈরব জোনের সভাপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান হেলিম। তিনি জানান, এই বিষয়ে তারা বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। তিনি এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
ভৈরব উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদীতে প্রভাবশালীদের মাছের অবৈধ ঘের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা কৃষিবিদ রিপন কুমার পাল। তবে তিন হাজার ৬১ জন নিবন্ধিত জেলে পরিবারের মধ্যে দুই হাজার জনকে জেলে সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছে বলে জানান।
এই প্রসঙ্গে অপর এক প্রশ্নের জবাবে রিপন কুমার পাল জানান, জেলে নিবন্ধন ও সহায়তা কার্ড প্রদান একটি চলমান প্রক্রিয়া। এলাকায় জেলে পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিবন্ধিত হবে এবং কার্ড দেওয়া হবে। সহায়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই অঞ্চলের জেলেদের সহায়তা দেওয়া এখনও শুরু হয়নি সরকারিভাবে। শুরু হলে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে ভৈরবের জেলেরা অবশ্যই সহায়তা পাবেন।
অপরদিকে কুলিয়ারচর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ওই উপজেলার এক হাজার ২৪৭ জন নিবন্ধিত জেলে পরিবারের মধ্যে ৯০৫ জনকে জেলে কার্ড দেওয়া হয়েছে।
নদীর প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা আইনত অপরাধ এই কথা উল্লেখ করে ভৈরব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জাকির হোসেন জানান, ভৈরবের মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদে কিছু দুষ্কৃতকারী অবৈধভাবে মাছের ঘের দিয়ে মৎস্যজীবীদের মাছ শিকারে বাধা দিচ্ছে। এই বিষয়টি জানতে পেরে এরই মধ্যে দুইদিনব্যাপী নদীতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বেশ কিছু ঘের অপসারণ করেছেন। পরে এসব ঘের যাতে না দিতে পারে এবং মৎস্যজীবীরা যাতে বাধাহীন মাছ শিকার করতে পারে, সেই বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নিবে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলরুবা আহমেদ জানান, নদ-নদীতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। নদ-নদীর উন্মুক্ত জলাশয়ে জেলেদের শতভাগ অধিকার। আর এই অধিকার সুরক্ষায় তাঁর প্রশাসন সদা তৎপর।
নদ-নদীর অবৈধ ঘেরসহ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনার কথা উল্লেখ করে ইউএনও আরো জানান, পরবর্তী সময়ে শুধু ঘের অপসারণ করা হবে না, সুনির্দিষ্ট আইনে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলাও দেওয়া হবে।