‘নিম্ন আদালতগুলো আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত হয়নি’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বারবার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও আজও নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন করা হয়নি। এর ফলে নিম্ন আদালতগুলো আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবমুক্ত হয়নি। বরং সাম্প্রতিক কিছু ন্যক্কারজনক ঘটনায় এই আদালতগুলোর ওপর শাসক মহলের রাজনৈতিক চাপ ও কর্তৃত্ব আরো বেড়েছে।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আজ বৃহস্পতিবার চতুর্থ দিনের মতো আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে বক্তব্য প্রদানকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫০ মিনিট থেকে দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেন খালেদা জিয়া। পরে বিচারক ২৩ নভেম্বর এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন রেখেছেন।
খালেদা জিয়া বলেন, ‘মাননীয় আদালত, মাজদার হোসেন মামলার আলোকে সংশ্লিষ্ট সকলে এবং আমরা আশা করেছিলাম, নির্বাহী বিভাগের আওতা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে সত্যিকারের স্বাধীন বিচার কায়েম হবে। কিন্তু আমাদের সকলের সে আশা চরমভাবে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। আমরা কী দেখতে পেলাম?’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘ন্যায়বিচারের সুযোগ আরো সীমিত হয়ে পড়েছে। জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার শেষ আশ্রয়স্থল সুপ্রিম কোর্টে সম্প্রতি কী ধরনের ন্যক্কারজনক ও নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, আপনি নিশ্চয়ই তা অবগত রয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ে আসীন প্রধান বিচারপতিকে কী ধরনের পরিণতির শিকার হতে হয়েছে তা সকলেই জানেন।’
‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই’
খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমের এখন কোনো স্বাধীনতা নেই। ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার ভয়ে তারা সত্য সংবাদ অবাধে প্রকাশ করার সাহস পায় না। তা সত্ত্বেও যতটুকু খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতে পেরেছে তাতেই বোঝা গেছে যে, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে তাঁর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেওয়া থেকেই প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের অপতৎপরতা শুরু হয়। শাসক মহল তাদের ক্রোধ ও ক্ষোভ গোপন রাখতে পারেনি। তারা প্রকাশ্যেই প্রধান বিচারপতিকে নানা রকম হুমকি দিয়ে আপত্তিকর ও আক্রমণাত্মক মন্তব্য করতে শুরু করে। সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার অপরাধে তাঁকে পদত্যাগ করে চলে যেতে বলা হয়।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিচারপতি সিনহা আত্মপক্ষ সমর্থনে বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দিয়েও ক্ষমতাসীনদের ক্রোধ প্রশমন করতে পারেননি। তাঁকে কয়েকদিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে প্রায় অন্তরীণ ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কাটাতে হয়। এরপর সরকারের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, বিচারপতি সিনহা অসুস্থ এবং তিনি বিদেশে যাওয়ার জন্য ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু মাননীয় আদালত আপনি জানেন, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে সাংবাদিকদের মাধ্যমে দেশবাসীকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে যান যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছেন।’
এ সময় সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাবেক প্রধান বিচারপতির একটি বক্তব্য উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ইদানীং একটি রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী আমাকে (এস কে সিনহা) ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে শঙ্কার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। অথচ তিনি বলে গিয়েছিলেন, ছুটি শেষে তিনি ফিরে আসবেন এবং দায়িত্বে যোগ দেবেন। কিন্তু এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ছুটিতে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ফিরে এসে স্বপদে বসা সুদূরপরাহত। তাঁর এ বক্তব্যে সরকারের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে এবং তাঁর কথাই বাস্তবায়িত হয়। আমরা সংবাদপত্র ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনেছি যে, প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় এস কে সিনহাকে অসুস্থ ঘোষণা করে ন্যক্কারজনকভাবে জোর করে ছুটিতে এবং দেশের বাইরে যেতে বাধ্য করা হয়। পরবর্তীতে দেশে না ফিরে পদত্যাগ করতে তাঁকে বিশেষ পন্থায় বাধ্য করা হয়েছে।’
‘এসবেও আমি ভীত নই’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘ক্ষমতাসীনদের পছন্দমাফিক রায় না দেওয়ার কারণে দেশের প্রধান বিচারপতিকে যেখানে এমন ভাগ্য বরণ করতে হয়, সেখানে অন্য বিচাররকদের সামনে ন্যায়বিচারের সুযোগ ও পরিবেশ কী আর থাকতে পারে? এই পরিস্থিতিতে দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর জনগণের কতটা আস্থা থাকতে পারে মাননীয় আদালত আপনি সেটা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন। ক্ষমতাসীনরা এই সেদিনও ফেনীতে আমার মোটরবহরে হামলা চালিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচার, হুমকি এবং মামলা নিয়ে আদালত অবমাননাকর বক্তব্য অব্যাহত আছে। এসবেও আমি ভীত নই।’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমার আশঙ্কার জায়গা হয়েছে, দেশে ন্যায়বিচারের পরিবেশ ও সুযোগ তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। কাজেই আদালতের কাছে আমি ন্যায়বিচার পাব কি না সেই সংশয় নিয়েই এই মামলায় আমাকে অত্র জবানবন্দি দিতে হচ্ছে।’
এর আগে বেলা পৌনে ১১টার দিকে রাজধানীর গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’ থেকে আদালতের উদ্দেশে বের হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে আদালতে পৌঁছান।
গত ৯ নভেম্বর খালেদা জিয়া তৃতীয় দিনের মতো আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন। এদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় খালেদা জিয়া স্থায়ী জামিনের জন্য আবেদন করলে তা খারিজ করে দেন আদালত। পরে বিচারক আজ এ মামলার পরবর্তী সময়ে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে দেন।
গত ২ নভেম্বর খালেদা জিয়া দুই মামলায় স্থায়ী জামিনের আবেদন করলে বিচারক তা নাকচ করে দেন। ফলে এখন প্রতি সপ্তাহেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদালতে হাজিরা দিতে যাচ্ছেন।