পাপন জনবিচ্ছিন্ন, দল চলে তিন ব্যক্তির মর্জিতে
কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর) আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন নির্বাচনী এলাকায় যান না। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর তেমন সংযোগ নেই। নেতা-কর্মীদের সময় দেন না। সুখ-দুঃখের কথাও শুনেন না। তাই তিনি বুঝতে পারছেন না তিন ব্যক্তি কিশোরগঞ্জের ভৈরবের আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে কীভাবে চরম সংকটের দিকে ধাবিত করছেন। তাঁদের মর্জিতে চলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
আজ সোমবার সকালে ভৈরব পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইফতেখার হোসেন বেনুর বাসভবন চত্বরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই কথা বলেন বক্তারা। এতে লিখিত বক্তব্য পড়েন ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল মনসুর। সংবাদ সম্মেলনে পদবঞ্চিত মনসুর-বেনু পক্ষের কয়েকশ নেতা-কর্মী উপস্থিত ছিলেন।
পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ইফতেখার হোসেন বেনুর সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তিন নেতা দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় করে জামায়াত-শিবিরের পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করছেন। যা সর্বশেষ দৃশ্যমান হয় সদ্য ঘোষিত ভৈরব উপজেলা ও পৌর কমিটিতে ওইসব লোককে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করা হয়েছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ওইসব নেতার নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের মোকাবিলা করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতটুকু ভালো ফল বয়ে আনা যাবে। তাই এই সংকট নিরসনে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার আশু দৃষ্টি কামনা করে বলা হয়, ভৈরবের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে নিতে ঘোষিত দুটি কমিটি বিলপ্ত করে সর্বজন গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠনের যেন নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিগত কয়েক বছরের স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট, বিগত দলীয় সম্মেলন, জাতীয় ও পৌর নির্বাচন-ইত্যাদি প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রথমেই বক্তব্য দেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ওমর ফারুক। পরে আজকের সংবাদ সম্মেলনের কারণ ব্যাখ্যা করে লিখিত বক্তব্য দেন ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল মনসুর।
আবুল মনসুর তাঁর লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এবং জেল-জুলুম সহ্য করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ করে আসা নেতাদের বাদ দিয়ে বর্তমান উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, একটি স্বার্থবাদী মহল নিজেদের আখের গোছাতে কোনো দিন আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন করেননি, এমন কি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদেরও সদ্যঘোষিত এইসব কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে বিগত দলীয় কাউন্সিলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হওয়ায় এবং পরাজিতদের সমর্থন করায় দলের দীর্ঘদিনে পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের ঠাঁই দেওয়া হয়নি ওই দুই কমিটিতে। এ সময় আবুল মনসুর এই হীনমানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে বলেন, এমন তেলবাজদের নিয়ে গঠিত সংগঠন দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের সংসদ সদস্য প্রার্থীর পক্ষে কোনোভাবেই ভোট টানা সম্ভব হবে না। মোকাবিলা করা যাবে না বিরোধীদলীয় কর্মসূচিকে। এসব তলিয়ে দেখতে এ সময় দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
এ সময় ভৈরবের আইনশৃঙ্খলা, মাদক, জুয়া ইত্যাদি পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে বলে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রতিটি মন্দ কাজের সাথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা জড়িত আছেন। যা স্থানীয় সংসদ সদস্য ও দলের মানহানীতে ভূমিকা রাখছে।
লিখিত বক্তব্যের পরে উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ইফতেখার হোসেন বেনু ও আবুল মনসুর আহমেদ। এ সময় জানান, বর্তমান কমিটিতে তাদের এবং তাদের অনুসারীদের না রেখে আওয়ামী রাজনীতি থেকে সরিয়ে ফেলার যে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, তা কিছুতেই বাস্তবায়িত হতে দেবেন না। তারা আওয়ামী রাজনীতি পরিত্যাগ করে নষ্টদের হাতে ছেঁড়ে দেবেন না। তবে এই পকেট কমিটির হয়েও রাজনীতি করবেন না। আলাদাভাবে রাজনীতির মাঠ নিজেদের দখলে রাখবেন। যত দিন না ঘোষিত এই দুই কমিটি বিলপ্ত করে পরীক্ষিত আওয়ামী লীগারদের দিয়ে নতুন করে কমিটি গঠন করা হবে।
কোন তিন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ-জানতে চাইলে আবুল মনসুর জানান, অভিযুক্ত তিন ব্যক্তি হলেন প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ব্যক্তিগত সচিব-২ লুৎফর রহমান ফুলু, ব্যক্তিগত সচিব-৩ সাখাওয়াত উল্লাহ মোল্লা ও ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. সায়দুল্লাহ মিয়া। এ সময় তিনি যোগ করেন, ফুলু মিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে গঠন করা শান্তি কমিটির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে আবুল মনসুর বলেন, পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেফায়েত উল্লাহ বর্তমানে ভারতে চিকিৎসাধীন আছেন। তাঁর অবর্তমানে তাঁকে উপজেলা কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ দিয়ে আমাদের ঐক্যে চিড় ধরানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
শেফায়েত উল্লাহর সাথে মোবাইল ফোনে তাঁর এ বিষয়ে কথা হয়েছে বলে দাবি করে আবুল মনসুর জানান, কমিটির তাঁকে রাখায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার হোসেন বেনু জানান, দলীয় মনোনয়ন দলের যে কোনো নেতা-কর্মী চাইতে পারেন। দেওয়ার এখতিয়ার দলনেত্রী শেখ হাসিনার। দলের গঠনতন্ত্রের কোথাও লেখা নাই যে এলাকার সংসদ সদস্যের পাশাপাশি অন্য কেউ মনোনয়ন চাইতে পারবেন না। এ সময় তিনি আগামী সংসদ নির্বাচনে নিজেকে এই আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রত্যাশী হিসেবে ঘোষণা দেন।
এ সময় প্রশ্নদাতার অপর এক সম্পূরক প্রশ্নের উত্তরে বেনু জানান, মনোনয়ন না পেলে তিনি দলের হয়ে যিনি পাবেন, তাঁর হয়েই কাজ করবেন।
সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখার হোসেন বেনু বলেন-ভৈরবকে জেলায় উন্নীতকরণ কেবল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রতিশ্রুতিই ছিল না, এটি আপামর ভৈরববাসীর একমাত্র প্রাণের দাবি। এই দাবিকে যিনি বা যারা প্রাণের দাবি বলে স্বীকার করেন না, ভৈরবের মাটিতে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই। এ সময় তারা ভৈরবকে জেলা করার দাবি পুনর্ব্যক্ত করে অবিলম্বে তা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি ভৈরবের ৭০ বছরেরও বেশি সময় আগে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী হাজী আসমত কলেজকে সরকারীকরণেরও দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে উপবিষ্ট ছিলেন আবুল মনসুর-ইফতেখার হোসেন বেনু সমর্থক আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের বেশ কয়েকজন নেতা।