রিকশাচালক আজিজুলকে স্যালুট
কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের বাসিন্দা রিকশাচালক আজিজুল হক (৩২)। প্রতিদিন ভৈরব শহরে রিকশা চালিয়ে যা পান তাই দিয়েই আটজনের সংসার চালান। সংসারে বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে আছে। এর মধ্যে বড় তিন মেয়ে স্কুলে পড়াশুনা করে। সবার ছোট ছেলের বয়স তিন বছর।
দরিদ্র সেই রিকশাচালকের সততায় মুগ্ধ হলেন সবাই। পেলেন টাকা ও সেলাই মেশিন উপহার।
গত ২ অক্টোবর সোমবার প্রতিদিনের মতো রিকশা নিয়ে ভৈরব শহরে বের হন আজিজুল হক। দুপুর ২টার দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভৈরব বাসস্ট্যান্ড দুর্জয় মোড়ে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এমন সময় তাঁর চোখে পড়ে একটি মোবাইল সেট পড়ে আছে রাস্তায়। তিনি এগিয়ে গিয়ে সেটি কুড়িয়ে নিয়ে একজন পথচারীকে দেখান। সেই পথচারী সেটটি দেখে বলেন, ‘অনেক দামি সেট। তুই এটা নিয়ে নে।’
কিন্তু আজিজুল তাঁর কথায় কান না দিয়ে সেটি নিয়ে দেন স্থানীয় শহীদুল্লাহ কায়সার কলেজের প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছে। জানান, তিনি শিক্ষিত মানুষ। মোবাইলের মালিককে খুঁজে যেন তাঁর হাতে তুলে দেন মোবাইলটি।
এ বিষয়ে জানতে জানতে চাইলে মো. শহীদুল্লাহ কায়সার বলেন, ‘আজিজুলের কাছ থেকে মোবাইল সেটটি পাওয়ার পর দেখি সেটি বন্ধ। পরে আমি তাৎক্ষণিক বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দিলরুবা আহমেদ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম সেন্টুকে জানাই। পাশাপাশি আমি আমার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে প্রকৃত মালিককে যোগাযোগের আহ্বান জানাই। আজ সকালে এক ব্যক্তি আমাকে ফোন করলে আমি তাঁকে ইউএনওর অফিসে যাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি সেখানে যান।’
মোবাইল সেটটির মালিক নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার তুলাতুলী গ্রামের জয়দর আলীর ছেলে শওকত আলী জানান, তিনি সিঙ্গাপুর প্রবাসী। বর্তমানে তিনি ছুটিতে আছেন দেশে। গত ২ অক্টোবর দুপুরে ভৈরব বাসস্ট্যান্ড হয়ে তিনি ভৈরব বাজারের দিকে যান রিকশায় করে। বাজারে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন প্যান্টের পকেটে থাকা তাঁর ‘আইফোন-৬ প্লাস’ মোবাইল ফোনটি হারিয়ে গেছে।
শওকত আলী আরো জানান, তিনি সিঙ্গাপুরের এক হাজার ৫৫৮ ডলার (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৯৪ হাজার ৭৪৭) দিয়ে ফোনটি কিনেছিলেন। এই সেটে তাঁর অফিশিয়াল অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। মোবাইল ফোনটি হারানোর পর তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন।
ইউএনও দিলরুবা আহমেদ বলেন, ‘আজ দুপুরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাকির হোসেনসহ আরো কয়েকজন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে শহীদুল্লাহ কায়সার রিকশাচালক আজিজুল ও মোবাইলের মালিক শওকত আলীকে নিয়ে অফিসে আসেন। বিষয়টি সম্পর্কে আমি আগেই অবগত ছিলাম। শওকত আলী সাহেব তাঁর দাবির সপক্ষে মোবাইলের প্রকৃত কাগজপত্র উপস্থাপন করেন। এ সময় তাঁকে মোবাইল সেটটি দেওয়া হয়। পরে আমি তাৎক্ষণিক উপস্থিত অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে আজিজুলের সততায় মুগ্ধ হয়ে আমরা তাঁকে একটি সেলাই মেশিন উপহার দিয়েছি।’
একই সময় মোবাইল সেটের মালিক শওকত আলী রিকশাচালক আজিজুলকে পাঁচ হাজার টাকা উপহার দেন। কিন্তু টাকা নিতে কোনোমতেই রাজি হচ্ছিলেন না আজিজুল। পরে অনেক জোরাজুরির পর টাকা নেন তিনি।
ইউএনওর কার্যালয়ে উপস্থিত ভৈরব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জাকির হোসেন তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই ডিজিটাল যুগে শ্রম বিকিয়ে খাওয়া একজন আজিজুল সততার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, তা অবশ্যই বিরল। তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে আমি স্যালুট জানাই।’
উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার স্বপ্না বেগম বলেন, ‘আজিজুল হকদের মতো মানুষগুলো এখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাস করেন বলেই এখনো আমাদের চারপাশ এত সুন্দর ও সুশৃঙ্খল।’
আজিজুল হককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, দামি মোবাইল সেটটি কোথাও বিক্রি না করে মালিককে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কেন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘মোবাইলডা তো আমার না। অন্যের জিনিস নেওয়া অন্যায়, গুনাহ।’