‘এস কে সিনহার অভিযোগগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে’
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
আজ শনিবার সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ কথা জানান।
মাহবুবে আলম বলেন, একজন বিচারপতি যদি বাইরে থাকেন এক মাসের জন্য বা ১৫ দিনের জন্য, তাহলে যিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারবেন না, নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না, এটা ঠিক না।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন যদি অন্য বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে না বসতে চান, তাহলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। সেই অচলাবস্থায় তো দেশ চলতে পারে না। এ জন্যই বাস্তবভাবে যদি অন্য বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে অনীহা প্রকাশ করেন, না বসেন তাহলে তো বিচারকাজ হবে না। সুতরাং বাস্তব অবস্থা বিচার করলে তাঁর (এস কে সিনহা) আবার ফিরে এসে বসা, এটা সুদূর পরাহত বলে আমার মনে হয়।’
বিদেশ যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি বলেছেন তিনি সুস্থ আছেন- এ ব্যাপারে মাহবুবে আলম বলেন, ‘ওনার চিঠিতে উনি বলেছেন অসুস্থতার কথা। উনি যাওয়ার সময় যদি বলেন এখন আমি সুস্থ, যেদিন যাচ্ছেন সেটা তো সেদিনকার কথা।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরো বলেন, ‘এখানে সুস্থতা-অসুস্থতার প্রশ্ন বড় না, উনি বিদেশে যাচ্ছেন, উনি স্পষ্ট বলছেন উনি স্ব-ইচ্ছায় যাচ্ছেন। কেউ জোর করে পাঠাচ্ছে না। তারপরে এই বিষয় নিয়ে আর কোনো তর্ক-বিতর্ক থাকা উচিত বলে আমি মনে করি না।’
মাহবুবে আলম আরো বলেন, যাঁরা প্রধান বিচারপতির ছুটির ব্যাপার নিয়ে, তাঁর কার্যভার নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন, সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্যে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলা উচিত নয় বলে তিনি মনে করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘সংবিধানের আর্টিকেল ৯৭ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না বা অসুস্থতা বা ছুটিতে আছেন, তখন রাষ্ট্রপতি জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দেন। আবদুল ওয়াহাব মিঞা তো সাংবিধানিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন।’
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘এই অভিযোগগুলো তো ল এনফোর্স এজেন্সির কাছে (আইন প্রয়োগকারী সংস্থা) আছে। রাষ্ট্রপতি অভিযোগগুলো সমন্ধে ভালো জানেন।’
আজ বিকেলে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলন, অর্থপাচারসহ ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিবৃতির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছাড়া আপিল বিভাগের অন্য পাঁচ বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর বাসভবন বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান। বিচারপতি ইমান আলী বিদেশে থাকায় অন্য চার বিচারপতি বঙ্গভবনে যান। তাঁরা হলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। সাক্ষাৎকালে এস কে সিনহার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগের দালিলিক তথ্যাদি চার বিচারপতির কাছে হস্তান্তর করেন রাষ্ট্রপতি।
সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ছুটি ভোগরত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা গতকাল শুক্রবার বিদেশে যাওয়ার আগে একটি লিখিত বিবৃতি উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে দেন। বিবৃতিটি সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই বিবৃতি বিভ্রান্তিমূলক।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বিচারপতি ইমান আলী ঢাকায় প্রত্যাবর্তনের পর ১ অক্টোবর আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি এক বৈঠক করে ১১টি অভিযোগ বিশদভাবে পর্যালোচনা করেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে, এসব গুরুতর অভিযোগ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে জানানো হবে। তিনি যদি এসব অভিযোগের ব্যাপারে কোনো সন্তোষজনক জবাব বা সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁর সঙ্গে বিচারালয়ে বসে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ সিদ্ধান্তের পর সেদিনই বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অনুমতি নিয়ে পাঁচ বিচারপতি ঢাকার হেয়ার রোডের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অভিযোগগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পরও তাঁর কাছে কোনো প্রকার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা সদুত্তর না পেয়ে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি তাঁকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, এ অবস্থায় অভিযোগগুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে তাঁদের পক্ষে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, সে ক্ষেত্রে তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে এ ব্যাপারে পরদিন অর্থাৎ ২ অক্টোবর তিনি তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। সেদিন তিনি বিচারপতিদের কোনো কিছু না জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত দেন। রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেন।
সুপ্রিম কোর্ট জানায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির অনুরূপ কার্যভার পালনে দায়িত্ব দেন।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, প্রধান বিচারপতির পদটি একটি প্রতিষ্ঠান। সেই পদের ও বিচার বিভাগের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থে এর আগে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে কোনো প্রকার বক্তব্য বা বিবৃতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নির্দেশক্রমে এ বিবৃতি দেওয়া হলো।
এর আগে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গতকাল শুক্রবার রাত ১১টা ৫৫টা মিনিটে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা হন। রাজধানীর হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবন থেকে বের হওয়ার সময় সেখানে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের তিনি বলেন, যথাসময়ে তিনি দেশে ফিরে আসবেন। একপর্যায়ে কাগজে লেখা একটি বিবৃতি দিয়ে দেন।
বিবৃতিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানীং একটি রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সাথে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’
গত ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে অবস্থানের জন্য অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে একটি চিঠি দেন। এতে তিনি ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বাইরে থাকার কথা উল্লেখ করেন।