মজুদ চাল দ্রুত বাজারে না ছাড়লে দুর্নীতির মামলা
মজুদ করা চাল দ্রুত বাজারে না ছাড়লে দুর্নীতির মামলায় পড়তে হবে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। মজুদদারদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘এই মামলা ক্যানসারের মতো, একবার এই মামলায় পড়লে আর রেহাই নেই।’
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে গণমাধ্যমের নির্বাহীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন দুদক চেয়ারম্যান।
দুদকের চলমান পাঁচ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা জানাতে দুদক কার্যালয়ে গণমাধ্যমের নির্বাহীদের আমন্ত্রণ জানান কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। সভার শুরুতেই তিনি দুদক সম্পর্কে গণমাধ্যমের মূল্যায়ন জানতে চান।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান রাহাত খান বড় বড় দুর্নীতিবাজদের ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ ক্ষেত্রে দুদকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা থাকা জরুরি। তিনি বলেন, ‘ধরবেন বড়দের। কারণ দুর্নীতি নানা কারণে হয়। একটা কারণ হচ্ছে যে একটা লোক সংসার চালাতে পারে না, অভাব-অনটন লেগে আছে। সে দুর্নীতি করে। আবার দেখেন, বিশাল মন্ত্রী, তিনি দুর্নীতি করতে পারেন।’
একুশে টিভির প্রধান নির্বাহী ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী নিজেও বলে দিল, বেসিক ব্যাংকের সমস্ত কিছু দিয়ে দিয়েছি দুদককে। দুদক ধরে না কেন। আপনি (চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ) কিন্তু এখনো ক্লিয়ার করতে পারেন নাই। দুদক কেন ধরে নাই।’
গণমাধ্যমের নির্বাহীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান জানান, কানাডা বা মালয়েশিয়ায় যেসব সরকারি কর্মকর্তা স্থায়ী নিবাস গড়েছেন, তাদের ব্যাপারে কাজ করছে কমিশন। তিনি জানান, দুদকের অনুসন্ধানে দেশে কোনো খাদ্যাভাব পাওয়া যায়নি।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘খাদ্য, দেশে কোনো অভাব নাই। আপনারা পত্রিকায় দেখেছেন। খাদ্যের প্রবলেম হচ্ছে মজুদদারির প্রবলেম। এবং কেন মজুদদারি হইছে আপনারা অনেকেই জানেন না। গভর্নমেন্টের সুন্দর সিস্টেম আছে, সেই সিস্টেম কেউ মানেন নাই। এই সিস্টেম কেন মানে নাই, আমরা বলছি ঘুষ খেয়েছেন বলে মানেন নাই।’
এ জন্য দুদক ১০ টাকার চালেও হস্তক্ষেপ করেছে, এখনো হস্তক্ষেপ করতে চায় বলে জানান দুদক চেয়ারম্যান।
এদিকে বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘দয়া করে অবৈধ মজুদ চাল দ্রুত বাজারে ছেড়ে দিন- নইলে দুদকের মামলায় পড়তে হবে। আর এই মামলা ক্যানসারের মতো, একবার এই মামলায় পড়লে আর রেহাই নেই।’
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু খাদ্যদ্রব্য মজুদদারি প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক যোগসাজশে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে খাদ্যদ্রব্য মজুদ করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে অনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন বলে কমিশনে অভিযোগ এসেছে। এই অভিযোগটি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কমিশন শিগগিরই অভিযোগ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় পয়েন্ট পদ্ধতি চালু করার বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কমিশনের অভিযোগ কেন্দ্রের হটলাইন ১০৬ মানুষের নানাবিধ অভিযোগ জানানোর প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। এ পর্যন্ত এই নম্বরে দুই লাখ নয় হাজার কল এসেছে। কিন্তু অধিকাংশ অভিযোগই কমিশন আইনের তফসিলবহির্ভূত। অভিযোগের পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকলে তা অনুসন্ধান করে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
পরে ইকবাল মাহমুদ রাজধানীর রাস্তায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে উল্টো পথে চলা গাড়ির বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একটা কাকতালীয় ব্যাপার হয়েছে, এটা স্পষ্ট করতে চাই। আমি বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। দেখি যে পুলিশের কর্মকর্তারা। ওনারা ওখানে অনেক জড়ো হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে হয়েছে যে ব্যাপারটি কী? তখন ওনারা বলল যে, স্যার প্রত্যেকদিন এইভাবে গাড়ি যায়। আমি বললাম, এটা তো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। ঠিক আছে, আমি কিছুক্ষণ দাঁড়াই। তবে আপনারা যে লোক যায় তারেই ধরবেন।’
ইকবাল মাহমুদ বলেন, গত এক বছরে মাধ্যমিক পর্যায়ে দেশের প্রতিটি জেলার একটি করে উপজেলায় দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ‘সততা স্টোর’ চালু করা হয়েছে এবং ব্যবস্থাপনার বিষয়ে দুদক তদারকি করছে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নিশ্চিতে হাজতখানা স্থাপন এবং এ সংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করা, আর্মড ও গোয়েন্দা ইউনিট গঠন এবং দুদকের সব সদস্যের কর্মপরিধি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া এ্যাসেট রিকভারি ইউনিট গঠন করা হচ্ছে।
মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, ২০১৭ সালে দুদকের তদন্ত অনুবিভাগ থেকে ২০১০টি অভিযোগের অনুসন্ধান করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮৪টি অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রাপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে ৬০৩টি অভিযোগ পরিসমাপ্তি এবং ১৮১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া এ বছর ১৩০৪টি মামলার তদন্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯৫টি সাক্ষ্য-স্মারক দাখিলের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬৩ চার্জশিট এবং ২৩২টি মামলার এফআরটি আদালতে দাখিল করা হয়েছে। মামলা তদন্তকালে ৭২ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
মানিলন্ডারিং অনুবিভাগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১১৪টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে। এর মধ্যে ২০টি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ হয়েছে। অনুসন্ধান শেষে নয়টি মামলা দায়ের করা হয়, ১৪টি অভিযোগ সমাপ্ত হয় এবং ৩৫টি অভিযোগ সিআইডি ও এনবিআরে পাঠানো হয়। এ পর্যন্ত মোট ২৪টি মানিলন্ডারিং মামলার রায় হয়েছে এবং ২৪টি মামলায়ই শাস্তি হয়েছে। এ বছর আটটি মামলায় রায় হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য দেন দুদক কমিশনার ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ, এ এফ এম আমিনুল ইসলাম, সচিব ড. মো. শামসুল আরেফিন, ৭১ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাইফুল আলম, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, এসএ টিভির চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিটিভির মহাপরিচালক হারুনুর রশীদ, ডিবিসি টিভির প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল ইসলাম, চ্যানেল আইর জাহিদ নেওয়াজ খান ও আরটিভির প্রধান নির্বাহী আশিকুর রহমান।