পদ্মায় ডুবে গেল পাঁচদিনের জীবন
ঘটনার মাত্র পাঁচদিন আগে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফুটফুটে মেয়েসন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন শরীয়তপুরের নড়িয়ার লুনশিং গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী পারভীন বেগম।
মা ও শিশু হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর গত রোববার রাতে সপরিবার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন মোহাম্মদ আলী (৩৮)। সদ্যজাত সন্তান ও স্ত্রী ছাড়াও তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন পারভীনের মা ফকরন বেগম (৫০)।
পরদিন সোমবার ভোরের আলো ফোটার আগেই নড়িয়া লঞ্চঘাটে ভেড়ে মোহাম্মদ আলী পরিবারকে বহনকারী লঞ্চ এমভি মৌচাক। বাইরে বেশ অন্ধকার থাকায় দিনের আলো ফোটার পরই লঞ্চ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন মোহাম্মদ আলী। ফলে নবজাতকসহ লঞ্চেই অপেক্ষা করতে থাকেন তিনি।
অবশ্য তখনো মোহাম্মদ আলী জানেন না, এই বসে থাকার সিদ্ধান্তই কাল হবে তাঁর জীবনে।
কিছুক্ষণ পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে লঞ্চেরই শৌচাগারে যান মোহাম্মদ আলী। স্ত্রীকে বলে যান, ‘ব্যাগ গুছায়ে রেডি হও, আমি আসছি।’ তবে কথা রাখতে ফিরে আসার সুযোগ পাননি তিনি। কারণ শৌচাগারে যাওয়ার পর মুহূর্তেই ঘাটে নোঙর করে থাকা লঞ্চটির ওপর এসে ভেঙে পড়ে পদ্মারপাড়ের একটি অংশ। ফলে নিমেষেই তলিয়ে যায় সেটি।
পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া মোহাম্মদ আলীকে উদ্ধার করে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন স্থানীয়রা। তবে খোঁজ পাওয়া যায়নি তাঁর স্ত্রী, নবজাতক আর শাশুড়ির। পরে আজ বুধবার বিকেলে পদ্মা নদীর সুরেশ্বর এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী পারভীনের লাশ।
ঘটনার তিনদিন পরে এখনো নিখোঁজ নবজাতক সেই শিশুটি, সঙ্গে তার নানিও। সেই সঙ্গে নিখোঁজ এই ঘটনার শিকার আরো ১৩জন। কেবলমাত্র দুজনের লাশ মিলেছে তিনদিনে।
নিখোঁজের তালিকায় আছেন বিঝারী গ্রামের সজল তালুকদার। স্থানীয় ভোজেস্বর বাজারে ব্যবসার পাশাপাশি নড়িয়া-২ লঞ্চেও চাকরি করেন তিনি। ভোরে লঞ্চটি ঘাটে পৌঁছার পর পরবর্তী যাত্রার আগে একটি কেবিনে ঘুমিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। ফলে ঘুমের ঘোরে কিছু বুঝে ওঠার আগেই তলিয়ে যান সজল। এখন তাঁর ছবি বুকে চেপে ঘাটে আহাজারি করছেন স্বজনরা।
অন্যদিকে ডুবে যাওয়া লঞ্চের কর্মী নিখোঁজ নড়িয়া উপজেলার হালইসার গ্রামের মানিক মাদবরের ছবি নিয়ে তিনদিন ধরে অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁর স্ত্রী সালমা বেগম। পণ করেছেন স্বামীর লাশ না নিয়ে ঘরে ফিরবেন না। এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই সাংবাদিকদের উত্তর দিলেন, ‘আমি আমার স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়িতে যাব। যে কোনো মূল্যে আমি আমার স্বামীর লাশ পেতে চাই।’
তবে কবে নাগাদ সালমা বা সজলের স্বজনরা তাঁদের লাশ খুঁজে পাবেন না এখনো জানেন না কেউ। কেন না প্রমত্তা পদ্মায় ডুবে যাওয়া তিনটি লঞ্চের মধ্যে কেবল একটির অবস্থান শনাক্ত করা গেছে। বাকি দুটি কোথায় আছে আর কোথায় ভেসে গেছে তার যাত্রীরা সেই প্রশ্নের উত্তর সবারই অজানা।