বদলে যাচ্ছে দেশের নবীনতম উপজেলার শিক্ষার চিত্র
কম্পিউটার চালনায় দক্ষ হয়ে উঠছেন দেশের সবচেয়ে নবীন উপজেলা চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকরা। সেই সঙ্গে প্রশাসনের সঙ্গে ই-মেইল বার্তার মাধ্যমে যোগযোগ রাখছেন তাঁরা।
গত তিন মাস হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের পর দক্ষ হয়ে উঠেছেন এসব শিক্ষক। পরিকল্পনা অনুযায়ী কম্পিউটার বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের পর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষিত করে তুলবেন।
কম্পিউটারে দক্ষ এসব প্রধান শিক্ষক এখন মুহূর্তের মধ্যেই যেকোনো তথ্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জানাতে পারছেন। ফলে সাশ্রয় হচ্ছে কর্মঘণ্টার। এভাবেই ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে এই উপজেলার শিক্ষার চিত্র। স্কুলের অবকাঠামো থেকে শুরু করে পাঠদান—সব ক্ষেত্রেই আসছে পরিবর্তন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর শিশুদের মতো আধুনিক শিক্ষা পেতে যাচ্ছে উপজেলার শিক্ষার্থীরা।
দেশের সর্বশেষ উপজেলা হিসেবে চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর যাত্রা শুরু হয় চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল। এটি দেশের ৪৯০তম উপজেলা। শিকলবাহা, জুলধা, বড় উঠান, চরলক্ষ্যারচর ও চরপাথরঘাটা ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত কর্ণফুলী উপজেলা। এর লোকসংখ্যা প্রায় তিন লাখ।
কর্ণফুলীর ইউএনও মো. আহসান উদ্দিন মুরাদ জানান, নতুন উপজেলার কোনো ভবন নেই। একটি ইউনিয়ন পরিষদে কয়েকটি কক্ষ নিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। নেই কোনো বরাদ্দ। অধীনস্থ কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীও নেই। অনেকটা নিধিরাম সর্দারের মতো তাঁকে কাজ করতে হচ্ছে।
এই কর্মকর্তা জানান, প্রথমেই প্রাথমিক শিক্ষাক্ষেত্রে কাজ শুরু করেছেন তিনি। উপজেলার ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে স্বপ্নের বিদ্যালয়ে পরিণত করার কাজ চলছে। তিনি জানান, উপজেলার অধিকাংশ শিক্ষকের কম্পিউটার দক্ষতা নেই। তাই সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দক্ষতা সমানভাবে তৈরি করতে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। রমজানের বন্ধে অধিকাংশ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে তাঁরা এখন স্কুলের সভাসহ বিভিন্ন নোটিশ ও তথ্য ই-মেইলের মাধ্যমে প্রশাসনসহ সবাইকে জানিয়ে দেয়। উপজেলা প্রশাসনের কোনো তথ্য প্রযোজন হলে একটি ই-মেইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে জানা যায় সব তথ্য।
ইউএনও বলেন, এখন সব মিটিং এর নোটিশ শুধু ই-মেইলে পাঠানো হয়। আগে উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের দিনের অর্ধেক সময় যেত ফোনে তথ্য চেয়ে, মিটিংয়ের নোটিশ দিয়ে। এখন একান্ত জরুরি না হলে ফোনের ব্যবহার বন্ধ। শিক্ষকদের দক্ষতার উন্নতি ও শেখার আগ্রহ অভাবনীয় বলেও জানান তিনি।
ইউএনও বলেন, যিনি কম্পিউটার অন করেতেই জানতেন না, তিনিও এখন গুগল ফরমে ই-মেইলে সার্ভে রিপোর্ট পূরণ করে পাঠান মোবাইল ফ্ল্যাটফর্ম থেকে কারো সহায়তা ছাড়া। তা-ও আবার ই-মেইল পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে।
প্রতিমাসে এক থেকে তিনজন শিক্ষককে ‘ টিচার অব দ্য মান্থ’ এবং প্রত্যেক স্কুলে প্রতি মাসে একজন ছাত্রকে সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের জন্য ‘স্টুডেন্ট অব দ্য মান্থ’ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে উপজেলার প্রত্যেক স্কুলে মিড ডে মিল চালু করা হবে।
গত মাসে (জুলাইতে) মাসিক সমন্বয় সভায় স্কিল অ্যাচিভমেন্টের জন্য আন্তর্জাতিক ওয়ারেন্টিসহ ভালো ব্র্যান্ডের ঘড়ি (সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের প্রশংসাপত্র) পুরস্কার পেয়েছেন মধ্য ইছানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম চৌধুরী।
প্রাথমিক শিক্ষা ছাত্রছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় ও শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য চমৎকার শিক্ষার পরিবেশ করার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান ইউএনও। এ লক্ষ্যে উপজেলার সব প্রাথমিক স্কুলে মাস্টারপ্ল্যান করে পর্যায়ক্রমে নতুন চিত্র আনা শুরু হয়েছে।
উপজেলার ৩৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাস্টার প্ল্যান তৈরিতে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা ইনস্টিটিউট, চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগ ও কম্পিউটার কৌশল বিভাগ।
এ ছাড়া চারুকলা ইনস্টিটিউট স্কুল অলংকরণের কাজ, কম্পিউটার কৌশল বিভাগ ডাইনামিক ওয়েবসাইট তৈরি ও শিক্ষা ইআরএফ ডেভেলপ করা এবং স্থাপত্য বিভাগ সকল স্কুলে ল্যান্ড স্ক্যাপ স্পেস ডিজাইন করছে।
আহসান উদ্দিন মুরাদ জানান, এসব কাজ মূলত করা হবে মাস্টার্স /স্নাতক লেবেলের ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস প্রজেক্ট হিসেবে। ফলে প্রশাসনকে এ সংক্রান্ত কোনো ব্যয়ও করতে হচ্ছে না।
নির্বাহী কর্মকতা মো. আহসান উদ্দিন মুরাদ আরো জানান, নতুন এ উপজেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ইউরোপীয় প্রাথমিক স্কুলের সমপর্যায়ে নেয়ার চেষ্টা করা হবে। মাস্টার প্ল্যান অনুসারে এবং বাজেট পাওয়া সাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে সব স্কুলকে এ প্রকল্পের আওয়তায় আনা হবে।
এ বিষয়ে বড় উঠান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আন্না ভট্টাচার্য এনটিভি অনলাইনকে জানান,আগামী বছরে তিনি সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাবেন। জীবনের শেষ সময়ে এসে ই-মেইলে যোগাযোগ করাটা শিখেছেন। গত দুই মাস খুব কষ্ট করেছেন। এখন তিনি কম্পিউটার বিষয়ে দক্ষ। তিনি বলেন, নতুন উপজেলা সৃষ্টির পর কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কম্পিউটার দক্ষতা প্রশিক্ষণ, স্কুলে মিড ডে মিল চালু, বিদ্যালয়ের নানা সমস্যা চিহ্নিত করে নিজেরা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। শিক্ষকদের জন্য অফিশিয়াল ড্রেস চালু করেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লাইব্রেরি ও স্কুলের ছাদে বাগান তৈরির মাধ্যমে নতুন ইতিহাস গড়েছেন।
শাহ মিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক চাপা চক্রবর্ত্তী জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ‘না’ বলে তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। এটি তার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা।
ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে এই শিক্ষক জানান, একদিন তাঁদের স্কুলে চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের একটি প্রতিনিধি দল আসার কথা ছিল। এ জন্য তিনিসহ অন্য শিক্ষকরা সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলেন। পরে প্রতিনিধি দলটি আসার পর উপজেলা কার্যালয়ে শিক্ষকদের আসার অনুরোধ জানান ইউএনও। কিন্তু শিক্ষক চাঁপা চক্রবর্তী বলেন, তাঁরা প্রতিনিধি দলের জন্য অপেক্ষা করছেন এবং স্কুলে প্রয়োজনে আরো অপেক্ষা করবেন। কিন্তু ওই মুহূর্তে উপজেলা কার্যালয়ে যাওয়া সম্ভব না। ইউএনওর এই আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে ‘না’ বলার কারণেই পরে তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোতাহের বিল্লাহ জানান, নতুন উপজেলা কর্ণফুলীতে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা অনন্য। শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে কর্ণফুলী থেকে। এখানে একজন ছাত্রের বইভিত্তিক জ্ঞানের ব্যবহারকরণ ও বিশ্লেষণ জ্ঞান উন্নতকরণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। এই পরীক্ষাটা আসলেই প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য এটি নতুন সংযোজন এবং ভিন্নমাত্রার একটি পরীক্ষা।
মোতাহের বিল্লাহ আরো জানান, ইউএনও উন্নত দেশের আদলে এ উপজেলায় প্রথম শুরু করেছেন। এ পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা নিজস্ব দক্ষতা ও পাঠের প্রতি মনোযোগী হবে। এটি আসলে প্রথমত পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করা হয়েছে। পরীক্ষার ফলাফল হাতে পেলেই তাঁরা বুঝতে পারবেন কোন বিদ্যালয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে।