মুক্তামনির পর ‘বড় আশা’ নিয়ে এসেছে সুমা
বিরল রোগে আক্রান্ত মুক্তামনির চিকিৎসা নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার মধ্যেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে প্রায় একই ধরনের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের শিশুকন্যা সুমা।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মুক্তামনির মতো ১০ বছর বয়সী সুমার হাত ফুলে ভারী হয়ে আছে। তার রক্তনালিতে টিউমার আছে। তবে সুমার অবস্থা মুক্তামনির চেয়েও জটিল।
গত ১৩ আগস্ট (রোববার) বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয় মুসকান আক্তার সুমা। এর আগে সুমা বাইরে চিকিৎসা করিয়েছে, অস্ত্রোপচার হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজে আসেনি। উল্টো সমস্যাটি প্রকট হয়েছে। তাই আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে সুমার। আগামী সপ্তাহেই তার চিকিৎসার জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হবে। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
আজ রোববার সকালে গিয়ে দেখা যায়, বার্ন ইউনিটের তিনতলায় সুমা চিকিৎসাধীন। সুমার ডান হাতটা ফুলে আছে। বুকের ডান পাশ থেকে শুরু করে আঙুলগুলো পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় টিউমারের চিহ্ন স্পষ্ট। পুরো হাতটাই অস্বাভাবিক রকমের ভারী। কাপড় দিয়ে হাতটি ঢেকে রাখছে সুমা। কেবল চিকিৎসকরা দেখতে চাইলে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সে।
সুমা রূপগঞ্জ উপজেলার গাউছিয়া এলাকার বাসিন্দা। হাসপাতালে সঙ্গে আছেন তার দাদি হালিমা বেগম। সুমার বাবা শফিকুল ইসলাম সুমন সৌদিপ্রবাসী। স্থানীয় একটি স্কুলে ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সুমা। হাতের সমস্যার কারণে পরে আর পড়াশোনা করতে পারেনি।
হালিমা বেগম এনটিভি অনলাইনকে জানান, সুমার জন্ম হয় অস্ত্রোপচারের (সিজারিয়ান) মাধ্যমে। জন্মের পর থেকেই ওর ডান হাতটা অস্বাভাবিক ছিল। ডান হাতটা ফুলে ছিল, বাঁ হাতের তুলনায় একটু মোটা ছিল। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমার হাতটাও ফুলতে থাকে। আঙুলগুলো অস্বাভাবিক হয়ে যায়। এখন কোনো কাজই করতে পারে না ওই হাত দিয়ে।
২০১২ সালে সুমাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে এবং পরে স্কয়ার হাসপাতালে। প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সেখানকার চিকিৎসকরা বিরল এই রোগের চিকিৎসা করতে আগ্রহী হননি। উপায় না দেখে পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।
২০১৪ সালে দুই দফা অস্ত্রোপচার হয় সুমার বুকে ও হাতে। তাতেও সমস্যা কোনো রকমফের হয়নি। তার পর থেকে আশা ছেড়ে দিয়ে নাতনিকে বাড়িতেই রেখেছিলেন হালিমা। আর সমস্যাও দিন দিন বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত গত ১৩ আগস্ট ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয় সুমা।
হালিমা বেগম বলেন, ‘বাবা, আমরা দেকলাম মুক্তামনি ভালো হইছে। ওরও তো (সুমা) একই অবস্থা। বড় আশা নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আইছি। এখন এখানকার ডাক্তররাই জানেন, কী করবেন?’ সুমার মা এখন বাড়িতে আছে বলে জানান তিনি। সুমার এক বড় ভাই আছে। ওর নাম শিহাব (১১)।
সকালে সুমাকে দেখছিলেন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ রবিউল করিম খান (পাপন)। সুমার সমস্যাটি কেন মুক্তামনির চেয়ে জটিল, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সুমার সমস্যাটা হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি জায়গা থেকে শুরু হয়েছে। ওখান থেকেই ওই টিউমারের জন্ম এবং ছড়িয়ে পড়া। এ কারণে সুমার ব্যাপারটা মুক্তামনির চেয়েও জটিল, গুরুতর এবং চ্যালেঞ্জিং।’
চিকিৎসক রবিউল করিম খান বলেন, ‘এখানে যে কাগজপত্রগুলো আমরা পেয়েছি, সেগুলো প্রায় সবই ২০১২ সালের। ফলে শরীরের বর্তমান অবস্থা জানার জন্যই সুমার শরীরের সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবার করা হবে। আশা করা যায়, আগামী সপ্তাহে একটি মেডিকেল বোর্ড করা হবে। ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এ ধরনের অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অঙ্গহানির একটি ঝুঁকি থাকে। মুক্তামনির ক্ষেত্রে ছিল, যদিও অস্ত্রোপচারের সময় তার হাতটি রক্ষা করতে পেরেছেন চিকিৎসকরা।
এ ব্যাপারে রবিউল করিম বলেন, ‘আমাদের টার্গেট হবে হাতটা রেখেই ওকে সুস্থ করে তোলা। ওর শরীরের টিউমার বেশ অ্যাগ্রেসিভ (কখন কোথায় ছড়াবে জানা যায় না)। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া জন্মগত ত্রুটি থাকলে আরো অন্যান্য সমস্যাও হয়। ওই সব সমস্যাও আমরা দেখার চেষ্টা করছি। তবে প্রচুর রক্তক্ষরণের আশঙ্কা এখানেও আছে। অস্ত্রোপচারের সময় প্রচুর রক্ত লাগবে, এটা নিশ্চিত।’
গত মাসে সাতক্ষীরা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মুক্তামনিকে সরকারি উদ্যোগে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুটির খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের পর সরকারের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার খরচ বহনের কথা জানান।
মুক্তামনিকে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁর শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেখেন এবং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা এ ধরনের জটিল অস্ত্রোপচারে করতে আগ্রহী নন বলে জানান। তখন ঢামেকের চিকিৎসকরাই সাহস করে মুক্তামনির অস্ত্রোপচারে এগিয়ে আসেন।
মুক্তামনি সাতক্ষীরার সদর উপজেলার কামারবায়সা গ্রামের ইব্রাহিম হোসেনের মেয়ে। তার এখন ১২ বছর বয়স। ছয় মাস বয়সে তার ডান হাতে একটি গোটা দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সেটি তার হাত থেকে বড় হয়ে যায়। ফলে চলাফেরা করতে সমস্যা দেখা দেয়। গত তিন বছর ধরে সে বিছানায় ছিল। গণমাধ্যমে এ খবর আসার পর সবাই মুক্তামনির রোগটির ব্যাপারে জানতে পারে।
এরপর গত ৫ আগস্ট মুক্তামনির ডান হাতের বায়োপসি পরীক্ষা করা হয়। ৮ আগস্ট মুক্তামনির চিকিৎসার জন্য গঠিত ১৩ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড তার বায়োপসি রিপোর্ট পর্যালোচনা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ আগস্ট মুক্তামনির সফল অস্ত্রোপচার হয়। এখন সে ভালো আছে। আরো কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করতে হবে তার।