‘সমস্যা হলে কী করুম ভাই’
আবদুল গফুর। বাড়ি জামালপুরে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার কাঁঠারবিল ইউনিয়নের নয়াগ্রামে। বন্যায় জমির ফসল নষ্ট হওয়ায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে এসে করছেন কুলির কাজ। মাথায় তুলছেন এক থেক দেড় মণ ওজনের ভারী বোঝা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে সেই কর্মযজ্ঞ।
এই যুগেও আবদুল গফুরের মতো কয়েকশ মানুষের এটাই প্রতিদিনের জীবন। রাজধানীতে নানামুখী জীবিকার মধ্যে শত শত গফুর দিনরাত খেটে যাচ্ছেন। নেই রাতে ঘুমানোর কোনো বিছানা, একটি ফলের দোকানের মেঝেতে ঘুমিয়েই কেটে যায় রাত! গোসল-খাওয়া সবই ভাসমান।
গফুর বলেন, জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন আবার এলাকায় পানি উঠেছে। অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী আর একমাত্র ছেলে আইয়ুব নবী পড়ছে স্কুলে। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাই স্ত্রী-সন্তানের কথা চিন্তা করে এই কষ্টের জীবিকা বেছে নিয়েছেন। মাথায় ভারী বোঝা নিয়ে ছুটতে হচ্ছে অনেক দূর।
মাথায় ডালিভর্তি পণ্য নিয়ে সারা দিন ছুটে দিনশেষে গফুরের পকেটে আসে ৪০০ বা ৫০০ টাকা। বাজার ভালো হলে আট বা দশ হাজার টাকা মাসে আয় করেন। তবে অনেক সময় মাসে ছয় বা সাত হাজার টাকাও পান। প্রতিদিন ১০০ বা ১২০ টাকা খরচ হয় তাঁর। বাকি টাকা রেখে দেন পরিবারের জন্য। ১০ থেকে ১৫ দিন পর বাড়ি যান, কিংবা বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেন। এবারও তিনি টাকা পাঠিয়েছেন স্ত্রীর কাছে। সেই টাকা থেকে ১০ বছরের সন্তান আইয়ুব নবীর জন্য ঈদের পোশাকও কিনতে বলেছেন। তবে তিনি নিজের জন্য ঈদে কিছুই কেনেননি!
আবদুল গফুর জানান, কারওয়ান বাজারে প্রতিদিন কুলির কাজ শুরু করেন ভোর ৩-৪টার দিকে। খুব ভোরে ডালি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এভাবে দুপুর ১-২টা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। এরপর বাজারে একটি ফলের দোকানে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে কাজে বেরিয়ে পড়েন। মাথায় ভারী বোঝা নিয়ে যান বিভিন্ন স্থানে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় কয়েক বহুতল ভবনে। এভাবে চলে রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত। তারপর খেয়ে আবার মেঝেতে ঘুমিয়ে যান।
গফুর আরো জানান, সারা দিন খেতে তাঁর খরচ হয় প্রায় ৮০ টাকা। সকালে রুটি বা অন্য কিছু খান, দুপুর-রাতে হোটেলে ভাত। আর ডালির জন্য প্রতিদিন দিতে হয় ২০ টাকা। আগে ১৫ টাকা ডালি ভাড়া থাকলেও আগস্ট মাসের প্রথম থেকে তা ২০ টাকা করা হয়। এ ছাড়া গোসল ও শৌচাগারের জন্য তাঁকে প্রতিদিন খরচ করতে হয় ৫ থেকে ৬ টাকা। তবে ঘুমানোর জন্য কোনো টাকা খরচ করতে হয় না।
এত বোঝা মাথায় নিলে সমস্যা হয় কি না- উত্তরে গফুর বলেন, ‘সমস্যা হলে কী করুম ভাই, করার কিছু আছে আর? কী কাজ করমু, ধান গাড়ছি (রোপণ), ধান খায়া গ্যাছে গা (নষ্ট হয়ে গেছে)। ইশকা (রিকশা) তো চলাই নাই, ওটা পাইও না।’
রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে মাথায় ভারী বোঝা নিয়ে যাচ্ছেন সিরাগঞ্জের বাসিন্দা নওয়াব আলী। ছবি : এনটিভি
একই পেশায় নওয়াব আলী
আবদুল গফুরের মতো সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা নওয়াব আলীও মিনতির কাজ করেন। অভাবের তাড়নায় তাঁকেও ভারী বোঝা বইতে হয়। অনেক সময় অসুস্থ হলেও পেটের টানে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। তিনি জানান, দিনে একবার গোসলের জন্য তাঁকে দিতে হয় ৫ টাকা। আর একবার শৌচাগার ব্যবহার করলে দিতে হয় ৫ টাকা। রাতে ঘুমানো ও ডালি ভাড়া হিসেবে দিনে ২৫ টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন যা রোজগার করেন, নিজে খেয়ে বাকিটা পরিবারের জন্য রেখে দেন।