বিদেশে নির্যাতিত, দেশে ‘অচ্ছুত’
গার্মেন্টে ভালো চাকরি দেওয়ার কথা বলে এক বছর আগে আনোয়ারা খাতুনকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দু-তিন দিন রেখেই শুরু হয় তাঁর ওপর পাশবিক নির্যাতন। এর পর তাঁর কাছে থাকা ৩০ হাজার টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সৌদি আরবের রিয়াদে। সেখানে তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয়। প্রায় নয় মাস আনোয়ারার ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন।
নানাভাবে যোগাযোগ, টাকা-পয়সা খরচ করে চার মাস আগে দেশে ফিরেছেন আনোয়ারা খাতুন। কিন্তু দেশে ফিরেও স্বস্তি মিলছে না সাতক্ষীরার কলারোয়ার গদখালি গ্রামের ওমর আলী সরদারের এই মেয়ের। স্বামী তাঁকে গ্রহণ করবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে সামাজিকভাবে করতে হচ্ছে তাঁকে দুঃসহ জীবনযাপন। এরই মধ্যে পাচারের অভিযোগে দালালদের বিরুদ্ধে মামলা করে আরেক যন্ত্রণায় পড়েছেন তিনি। বিচার তো দূরের কথা, উল্টো দালালদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে তাঁকে।
শুধু আনোয়ারাই নন, এ রকম ঘটনার শিকার আরো অনেকে। এমন আরেকজন সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কুশখালি গ্রামের গ্রাম পুলিশ নজরুল ইসলামের স্ত্রী মোসলেমা খাতুনের।
দুই নারীই জানান, তাঁদের মতো অনেক বাংলাদেশি নারী বিদেশে পাশবিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাঁরা দেশে ফিরতে পারলেও অন্য অনেকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না।
পাচারের গল্প
পাচারের বর্ণনা দিয়ে আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন আশাশুনি উপজেলার গোদাড়া গ্রামের ইমদাদুল সরদারের সঙ্গে। বেশ চলছিল তাঁদের সংসার। ভালো চাকরির কথা বলে কালীগঞ্জের বাঁশতলার রহিম মোড়ল, তারালির সোনা শেখ আর বাগআঁচড়ার আবদুল গনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। পরে তারা আমাকে রিয়াদে নিয়ে বিক্রি করে দেয়।’
সদর উপজেলার কুশখালি গ্রামের মোসলেমা খাতুন বলেন, ‘বিদেশে গেলে অর্থ উপার্জন বেশি হবে, সংসারও চলবে ভালোভাবে—এ ধারণা পেয়েই লেবানন যেতে সম্মত হয়েছিলাম। দুবাইতে নিয়ে এক রাত রাখা হয়। এর পর নিয়ে যাওয়া হয় লেবাননে। সেখানে আমাকে বিক্রি করে দেয় দালালরা।’ প্রথম মাসখানেক ভালোই ছিলেন তিনি। তারপর নেমে আসে পাশবিক নির্যাতন।
নির্যাতনের রকমফের
পাশবিক নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে চোখ জলে ভেসে ওঠে আনোয়ারার। তিনি জানান, প্রতিদিন সকাল-বিকেল-রাতে পাঁচ/ছয়জনের বেশি পুরুষ তাঁর ওপর নির্যাতন করত। তাঁকে বারে পাঠানো হতো। বাইরে থেকেও লোক নিয়ে আসা হতো তাঁর কাছে। অপারগতা প্রকাশ করলে চলত নানা নির্যাতন। শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেও চলত নির্যাতন।
অন্যদিকে মোসলেমা জানান, এবাড়ি-ওবাড়ি এখানে-ওখানে নিয়ে তাঁর ওপর চলতে থাকে বহু পুরুষের নির্যাতন। অপারগতা প্রকাশ করলেই বেড়ে যেত নির্যাতনের মাত্রা। প্রতিদিন চার-পাঁচজনের পাশবিক নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করতে হতো তাঁকে। এভাবে চলেছে টানা পাঁচ মাস। প্রতিবাদ করার সাহসও হতো না।
দেশে ফিরলেন যেভাবে
নির্যাতন সইতে না পেরে একপর্যায়ে আনোয়ারা তাঁর মা নাসিমার কাছে আত্মহত্যার কথাও বলেন। এরপর তাঁর মা বিষয়টি সবার কাছে জানান এবং প্রতিকার দাবি করে মেয়েকে ফেরত চান। অবশেষে সেনাবাহিনীতে কর্মরত তাঁদেরই এক আত্মীয়ের সহযোগিতায় আনোয়ারা দেশের মাটিতে ফিরে আসেন মাস চারেক আগে। গ্রামের বাড়ি আশাশুনির হাঁড়িভাঙ্গার তিন শতক জমি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে সেই টাকা খরচ করে দেশে ফেরেন আনোয়ারা।
মোসলেমা জানান, উপর্যুপরি নির্যাতনে লেবাননে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তখন তাঁকে ভর্তি করা হয় সেখানকার একটি হাসপাতালে। সেখানেই পরিচয় হয় বাংলাদেশের বরিশালের মেয়ে আয়েশা খাতুনের সঙ্গে। পাশবিক অত্যাচারে নাজেহাল আয়েশা খাতুনের মাধ্যমে মোসলেমার যোগাযোগ হয় বাড়িতে। পরে ৪০ হাজার টাকা খরচ করে দেশে ফিরে আসেন মোসলেমা।
ফিরেও ‘অচ্ছুত’
আনোয়ারা বলেন, ‘দেশে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হই। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর জানতে পারি আমার বিরুদ্ধে নানা সমালোচনার কথা। গ্রামজুড়ে সব সময় একই সমালোচনা। সমাজে কেউ আমাকে ভালোবাসে না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে যেতে না করে দিয়েছে। স্বামী গ্রহণ করবে না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।’ শরীরে নানা সমস্যা জানানোর মতো কেউ নেই বলেও আক্ষেপ করেন আনোয়ারা।
মোসলেমা জানান, শরীরে এখনো ক্ষত রয়েছে। নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাঁকে। ওষুধ না খেলে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তিনি আরো জানান, সমাজে এখন তিনি অচ্ছুত। কেউ তাঁকে ভালো চোখে দেখে না। দরিদ্র পরিবার তাঁর। কারো বাড়িতে কাজ করার সুযোগ পান না তিনি। কোনো অনুষ্ঠানেও তিনি অবাঞ্ছিত। পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে মোসলেমা এখন বড়ই অসহায়।
মামলা করে বিপাকে
দালাল সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মামলা করে বিপাকে আছেন আনোয়ারা। তিনি জানান, পাচারের অভিযোগে তাঁর মা নাসিমা খাতুন সাতক্ষীরার তিন দালালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। দালালরা এখন শুধু ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। বলছে, ‘হয় মামলা তুলবি, না হয় আবার বিপদে পড়বি।’
বাড়ি ফিরে মোসলেমাও মামলা করেছেন দালাল ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে। সেই দালাল এখন তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে নতুন করে হুমকি দিচ্ছে।
আনোয়ারার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কলরোয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) পিন্টু লাল গাইন বলেন, ‘আনোয়ারার মা বাদী হয়ে করা মামলার আসামিকে আমরা ধরার চেষ্টা করছি। খুব তাড়াতাড়ি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’