যানজটে ঢাকায় দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট
বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, গত ১০ বছরে রাজধানী ঢাকার যান চলাচলের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে সাত কিলোমিটার পর্যন্ত নেমে এসেছে। অথচ হেঁটে চলার গড় গতি হচ্ছে পাঁচ কিলোমিটার। ঢাকার যানজটের কারণে দিনে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
১৯৯৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে ঢাকার রাস্তা ৫ শতাংশ, জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ ও যান চলাচল ১৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকার নগরায়ণ কেন্দ্র থেকে উত্তর দিকে এবং তার পর পশ্চিমাভিমুখে সম্প্রসারিত হয়েছে। মহানগরীর পূর্ব দিকে বেশির ভাগ এলাকা এখনো গ্রামীণ, তবে দ্রুত বিকাশ লাভের সুযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংক আরো বলছে, মহানগরীর দ্রুত সম্প্রসারণের সঙ্গে ঢাকার নগর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে একটি বিশৃঙ্খল ও অসম নগরায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাবে অধিক ঘনবসতি, বসবাসের নিম্নমানের পরিবেশ তৈরি এবং বন্যা ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩৫ লাখ বস্তিবাসী মৌলিক ও অবকাঠামো সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
ঢাকায় একটি পাঁচতারকা হোটেলে উচ্চ পর্যায়ের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক ‘টুয়াডর্স গ্রেট ঢাকা : এ নিউ আরবান ডেভেলপমেন্ট প্যারাডাইম ইস্টওয়ার্ড’ বিষয়ক প্রতিবেদনে এ অভিমত তুলে ধরেছে। গতকাল বুধবারের এ আয়োজনে ২০৩৫ সালে ঢাকার অগ্রগতির জন্য উন্নয়ন পন্থাবিষয়ক এ সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এতে অন্যান্যের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফান এবং সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ইউ লি বক্তব্য দেন।
দ্বিতীয় অধিবেশনে দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী শিলা দীক্ষিত, ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের মেয়র আনিসুল হক ও দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান বক্তব্য দেন। এতে চীনের সাংহাই নগরীর সাবেক ভাইস মেয়র ঝাও কিঝেংয়ের সাংহাই ও পুদং এলাকার রূপান্তরের ক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতার একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়।
সম্মেলনের অন্য তিন অধিবেশনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আজম, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান, মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাশেম খান, বিশ্বব্যাংকের লিড অর্থনীতিবিদ ইফাত শরীফ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আকতার মাহমুদ প্রমুখ বক্তব্য দেন।
সম্মেলনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যান্থনি ভেনাবল্স ২০৩৫ সালের দিকে ঢাকার উন্নয়নের জন্য চারটি সিমুলেশন পরিস্থিতি উপস্থাপন করেন।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্যে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ঢাকার আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের মাত্র ১ শতাংশ হলেও এ নগর দেশের মোট জিডিপির ৩৬ শতাংশ জোগান দিচ্ছে এবং ৪৪ শতাংশ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। এ পরিসংখ্যান ঢাকার অর্থনৈতিক তাৎপর্যকে তুলে ধরে। ঢাকাকে ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশের রাজধানী এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের রাজধানী হিসেবে ধারাবাহিকভাবে গড়ে তোলা হবে।
‘ঢাকায় জনসংখ্য দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা তিন কোটি অতিক্রম করবে। সামনে এ মহানগরীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মেটাতে সরকার সব সেবা সংস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।’
মন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের আয়তন ২৭০ বর্গকিলোমিটার হয়েছে, যা আগের ১২৭ বর্গকিলোমিটারের তুলনায় প্রায় ১১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বর্ধিষ্ণু আয়তনানুসারে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোরও সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। দুই সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য নাগরিক সুবিধা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক বলেন, ঢাকা নগরীর মূল সমস্যা হচ্ছে ঘনবসতি, ড্রেনেজ, দূষণ, অধিকসংখ্যক যানবাহন। এসব সমস্যা সমাধানে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ঢাকার উন্নয়নে সিটি গভর্নমেন্ট করার কথা জানান।
অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন রামা বলেন, ঢাকার বিশাল ও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবেচনায় অত্যধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর উন্নয়ন করার প্রয়াসের চেয়ে পূর্ব ঢাকার টেকসই উন্নয়ন অনেক বেশি কার্যকর ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে। এখনই এই কাজ করার উপযুক্ত সময় বলে তিনি উল্লেখ করেন।