‘আমাগো লাইগ্যা ঈদ আহে নাই’
‘বাবা আমাগো লাইগ্যা ঈদ আহে (আসে) নাই। ঈদ আইলে দুঃখ আরো বাড়ে। ঘরে ভাত নাই, কাপড় নাই, ঈদ দিয়া কী অইবো। আল্লাহ কি আমাগোরে দেহে না! এর চেয়ে মইরা যাওয়া ভালা।’
আজ সোমবার ঈদের দিন দুপুরে কথা হয় রাজধানীর শাহজাহানপুরের এজি কলোনির পাশে রাস্তার ফুটপাতে বসবাস করা ৮০ বছরের বৃদ্ধা আমেনা বেগম। বয়সের ভারে প্রায় নুয়ে পড়েছেন। এই ফুটপাতে বসবাস করছেন জীবনের ২৫টি বছর। ঈদের দিনে খাওয়ার নাই, পরার মতো নতুন কোনো কাপড় নেই। এই দুঃখ শোনারও কেউ নেই। বসে বসে কান্না ছাড়া আর কী করার আছে আমেনার।
আমেনা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামালপুরে তাঁর বাড়ি। স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলে চার মেয়ে নিয়ে ২৫ বছর আগে ঢাকায় চলে আসেন। শুরুতে কমলাপুর রেল স্টেশনের একটি বস্তিতে থাকতেন। কিন্তু সেখানে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়ার পর চলে আসেন শাহজাহানপুরের এজি কলোনির পাশে রাস্তার ফুটপাতে। তখন থেকেই ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর একে এক ছেড়ে চলে গেছে দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে। একটিমাত্র বেঁচে আছে। ওই মেয়ের সঙ্গে তিনি ফুটপাতে দিনাতিপাত করেন। ভয় করেন কখন ওই মেয়ে আবার ছেড়ে চলে যায়! তাই ভাবেন তার আগে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
আমেনা বেগম জানান, ঈদের সময় ব্যতীত অন্য সময় না খেয়েও থাকেন। তখন এত খারাপ লাগে না। কিন্তু ঈদ আসলে কষ্ট যেন আরো বেড়ে যায়। কিছু পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবাগো হাঁটতে পারি না। তাই কিছুই পাই নাই।’
একই ফুটপাতে বাস করেন মাজেদা বেগম (৬৫) আর তাঁর পঙ্গু স্বামী আনসার আলী(৭০)। দুপুরে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফুটপাতে বসে আছেন সাহায্যের আশায়। ঈদের দিনেও তেমন কিছুই পাননি। শুধু এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একটি বিরানির প্যাকেট দিয়ে গেছেন। দুজনের জন্য এই ছিল একমাত্র খাদ্য। নতুন কাপড় নেই। তাই পুরোনো কাপড় পরেই ঈদ পার করছেন তাঁরা।
মাজেদা বেগম জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়িও জামালপুরে। স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছেন। ৩৫ বছর ধরে তাঁরা এই ফুটপাতে আছেন। সারাদিন ভিক্ষা করে যা পান তা দিয়ে সংসার চলে। ছেলেমেয়ে কেউ নেই। খাওয়া-ঘুম, রোদ-বৃষ্টি সবই এই ফুটপাতে। গোসল করেন রমনা লেকে।
ঈদের সকাল কীভাবে যাচ্ছে? জবাবে মাজেদা বেগম বলেন, ‘ভালো খাওন নাই, কাপড় নাই, ঈদ আর কী বলব বাবা।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ছিন্নমূল মানুষের ঈদ উদযাপনের এমন চিত্রই দেখা গেছে। কমলাপুর রেল স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, ফিরোজা বেগম নামের এক মধ্যবয়সী নারী ভৈরব থেকে দুই ছেলে আর এক নাতিকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন সাহায্যের আশায়। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সাহায্য তুলেছেন। এখন দুটি ব্যাগে করে কাপড় আর খাবার নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন ভৈরবে।
রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ফিরোজা বেগম জানান, ‘গ্রামে অভাব অনটনে অনেক কষ্টে দিন পার করছি। এক সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসেছি। বিভিন্ন বাসাবাড়ি এবং এলাকা থেকে শাড়ি, লুঙ্গি, সেমাই পাইছি। এটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি। বাড়িতে যাওয়ার পর ঈদ উদযাপন করব।