সাক্ষাৎকার
ছাত্রলীগ নামধারীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছি : মলয় ভৌমিক
চলতি বছরের ১২ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সংস্কৃতিকর্মী বাসু দেবের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদের আন্দোলনে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। বাংলার বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক ও শিক্ষাবিদ এই মানুষটি মলয় ভৌমিক। বাংলাদেশে পথনাটক আন্দোলন, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মুক্ত নাটক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে রয়েছে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই মলয় ভৌমিক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপনা করলেও নাট্যজন হিসেবেই বেশি পরিচিত। এ ছাড়া তিনি রাবির নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৫৬ সালে ১ মে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলায় জন্মগ্রহণ করা মলয় ভৌমিকের ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধেও ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। ১৯৯৩ সালে রাবির সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন তিনি। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের জীবনে ২০০৭ সালের ২৪ আগস্ট সরকারের মানবাধিকার পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। রাজনৈতিক-সচেতন এই মানুষটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫টি নাটকে অভিনয়, ২২টি নাটক রচনা এবং ৩২ নাটক নির্দেশনা দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি অনুশীলন নাট্যদলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান দলপ্রধান।
নাট্যজন মলয় ভৌমিক তাঁর কৃতিত্বের স্বরূপ পেয়েছেন ১৯৯২ সালে ঢাকার লোকনাট্যদল ‘নাট্যকর্মী পদক’, ২০০৮-এ ‘মুনীর চৌধুরী সম্মাননা’, ২০০৯-এ শিল্পকলা একাডেমি কৃর্তক ‘আরণ্যক দীপু স্মৃতিপদক’সহ বিভিন্ন ধরনের পুরস্কার। গুণী এই মানুষটির সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় রাবির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, রাজনীতিসহ সমসাময়িক বিষয়ে।
প্রশ্ন : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক চর্চার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। শুরুর দিকে এর ধরনটা কেমন ছিল?
মলয় ভৌমিক : শুরুর দিকে, মানে আমি যদি স্বাধীনতার পর পরের কথা বলি, তাহলে প্রচুর সংস্কৃতি চর্চা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো ধারাবাহিকতা ছিল না। যেমন হয়েছে বিভাগকেন্দ্রিক বা হলকেন্দ্রিক। মেয়েদেরসহ প্রতিটি হলে বার্ষিক নাটক হয়েছে। নানা ধরনের কালচারাল উইক হয়েছে। আবার বেশির ভাগ বিভাগ বিশেষ করে বাংলা, ইংরেজি, পলিটিক্যাল সায়েন্স, ম্যানেজমেন্ট এগুলো ছিল সংস্কৃতিমনা। বিভাগগুলো থেকে বছরে সাংস্কৃতিক কমপিটিশন হয়েছে। আর যেটা হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সম্মেলন-টম্মেলন উপলক্ষে ছোট নাটক বা সংগীত অনুষ্ঠান এগুলো। দু-একটি বিচ্ছিন্ন সংগঠন ছিল; সেগুলো হয়তো এক-দেড় বছর টিকেছে, কোনোটা টেকেনি। যেমন একটি সংগঠন ছিল ‘চারুলি’। এটি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ছিল। তারপরে ছাত্র ইউনিয়নের ছিল ‘সংস্কৃতি সংসদ’।
প্রশ্ন : সময়কালটা ...
মলয় : এটি ’৭৪ থেকে পরবর্তী ’৭৭-৭৮ পর্যন্ত। এই সংগঠনগুলো কোনো ধারাবাহিক কাজ করেনি। এখন যেমন হয় সংগঠনগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় রেগুলার বসে। এগুলো কিন্তু আগে ছিল না, বিচ্ছিন্ন ছিল।
প্রশ্ন : রেগুলার বসা কবে থেকে শুরু হলো?
মলয় : এটি শুরু হয় প্রথম ’৭৭ সালে; এ সময় বাংলাদেশে একটি নাট্য প্রশিক্ষণের আয়োজন হয়, আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। এটি বাংলাদেশে প্রথম রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে হয়। সেটি শিক্ষকরা, বিশেষ করে অধ্যাপক আলী আনোয়ার, হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ, সনৎ কুমার সাহা, জুলফিকার মতিন এঁদের উদ্যোগে তিন সপ্তাহের এই নাট্য প্রশিক্ষণ কোর্স হয়। আর সংগঠনের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’। এটি পরপর দুই বছর হয়েছিল। তারপর গ্যাপ দিয়ে আবার আরেকটা হয়েছিল। এই ওয়ার্কশপের মধ্য থেকে নাটকের আধুনিক ভাবনা আসে। এর মধ্যে তো সারা দেশে, বিশেষ করে ঢাকায় গ্রুপ থিয়েটার গড়ে ওঠে। দর্শনীর বিনিময় নাটক দেখা। রেগুলার নাটকের শো করা, এক নাটকের হয়তো বেশি শো করার চেষ্টা করা। আর তার আগে ছিল শৌখিন, একটা-দুইটা শো করেই শেষ হয়ে যেত। শৌখিন চর্চা থেকে সারা দেশে এই ধারাটাও আমরা তখন; মানে আমি ’৭৪ -৭৫ সেশনে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম। তখন আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি যে, ঢাকায় নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু হয়েছে।
এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল-টলে আমরা নাটক করছি। স্যারদের প্রেরণায় এগুলো, বিচ্ছিন্নভাবে। থিয়েটার ওয়ার্কশপ হওয়ার পরই কিন্তু আমাদের ধারাবাহিক নাট্যচর্চা শুরু হয়। প্রথমে নাটকের গ্রুপগুলোই বেশি এগিয়ে আসে। আর নাট্যচর্চার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয় যে, করা যায় কি না নিয়মিত চর্চা। ’৭৭ সালের ওয়ার্কশপটিতে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখন যারা এই ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করে, তাদের নিয়েই যাত্রা শুরু ধারাবাহিক নাট্যচর্চার প্রথম সংগঠন, অনুশীলন নাট্যদল। এটি ’৭৯ সালে আমরা প্রতিষ্ঠা করলাম। এখন পর্যন্ত এটি টিকে আছে। এ রকম কিন্তু ধারাবাহিক...
প্রশ্ন : এর প্রতিষ্ঠাতা কি আপনিই ছিলেন?
মলয় : না। অন্যদের মধ্যে আমি অন্যতম। ওই যে বললাম, যারা ওয়ার্কশপ করেছিলাম তাদের মধ্যে প্রায়ই আমরা সমসাময়িক ছিলাম। আমি, সুখেন মুখোপাধ্যায়, শামসুল আলম বকুল এরা প্রধানত।
প্রশ্ন : অনুশীলন তো এখনো কাজ করে যাচ্ছে...
মলয় : এখনো কাজ করে যাচ্ছে। আমি বলি, এর দুই বছর পরে সমকাল এলো। আড়াই বছর পর রোডা এলো। এগুলো কিন্তু অনেক পুরোনো সংগঠন। এবং এই নাট্যসংগঠনগুলোই প্রথমদিকের। তারপরে আসতে আসতে আবৃত্তি সংগঠন সনন; তারপরে উদীচী, গণশিল্পী সংস্থা এলো। তখন থেকে সবাই প্রায় ধারাবাহিক। কিন্তু সব থেকে ধারাবাহিকভাবে সংস্কৃতি চর্চার প্রথম সংগঠন হলো অনুশীলন নাট্যদল। আর এই অনুশীলন নাট্যদলের পাঁচ বছর পূর্তি হয় ’৮৪ সালে। এই ’৮৪ সালে আমরা দেখলাম যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে যদি সাংস্কৃতিক চর্চা করতে চাই গানের সংগঠন, নাটকের সংগঠন। তাহলে আমাদের নিয়মিত কম পয়সায় অডিটরিয়াম দরকার। মহড়ায় জয়গা দরকার। এ রকম কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে আমরা অনুশীলন নাট্যদলের পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে সব সাংস্কৃতিক সংগঠনকে ডেকে বসি। বসার ফলে প্রথম জোট। এমনকি আমরা বলি, বাংলাদেশে প্রথম সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আমরা করি। তখন নাম ছিল ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোট’।
এখন ‘কেন্দ্রীয়’ কথাটা এসেছে, এটা অনেক পরে হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট আমরা গড়লাম ১৯৮৪ সালে; বিভিন্ন সংগঠনকে নিয়ে, তখন ১০টার মতো সংগঠন এর সাথে যুক্ত ছিল। কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা বিভিন্ন রকম দাবি-দাওয়া দিলাম। এর মধ্যে একটি ছিল টিএসসি (টিএসসিসি) প্রতিষ্ঠা। কেননা ঢাকা ইউনিভার্সিতে টিএসটি পাকিস্তান আমলেই হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অ্যাক্টের সাথে যুক্ত, যেখানে আছে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটি হতে হবে। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি থাকতেই হবে। তো আমরা তখন রূপরেখা প্রণয়ন করলাম, এই জোট থেকে। এর মধ্যে সিনেট অধিবেশন হলো। সিনেটের ছাত্র প্রতিযোগীরাও বলল অবিলম্বে টিএসসি করো। তখন সিনেট থেকেও প্রস্তাব নেওয়া হলো, এখানে একটি টিএসসি হোক। সেই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের জোটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং ’৮৪ সালের পরপর দুটি সভার মধ্য দিয়ে রূপরেখা প্রণীত হয়। দুটি সভাতেই সভাপতিত্ব করি আমি। এবং অন্যান্য সংগঠনের সবাই উপস্থিত ছিল, আমরা একটি রূপরেখা জমা দেই। সেই ’৮৪ সাল থেকে লাগাতার আন্দোলনের ফলে গত ৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ প্রথম ক্ষমতায় এলো তখন নীতিগতভাবেই এটা তারা মেনে নেন। নীতিগতভাবে মেনে নিল, কিন্তু কাজ শুরু হলো না।
প্রথম টিএসসির ডিরেক্টর বানাল নাজিম মাহমুদকে। ডিরেক্টর হলো কিন্তু কোনো অবকাঠামো নাই, কোনো কিছুই নাই। আমরা কিন্তু টিএসসির অবকাঠামোর জন্য এখন পর্যন্ত আন্দোলন করে যাচ্ছি। এইটার কিছুটা ফান পাতার চেষ্টা করেছিল। এর মধ্যে তো আবার বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় এলো। তারা সেই ফানটি পেয়েই, এখন যেটা হচ্ছে, যত অকেজো কিছু হয়। মাত্র আড়াই আসনের অডিটরিয়াম, এত বড় ইউনিভার্সিটি! পাকিস্তান আমলেই হওয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তখনই ৫০০ সিটের বড় অডিটরিয়াম। বিশাল কমপ্লেক্স, বড় বড় রুম। আর এখানে যাতে কেউ কাজ করতে না পারে চালাকি করে ডেস্ট্রয় করার জন্য এ রকম একটি পরিকল্পনা নেয়। তাও ওপর থেকে ছাদ ধসে পড়ল দুবার। তখন তদন্ত কমিটি হয়ে কিন্তু অনেকে ফেসেও গেল। সেই জিনিসটি কিন্তু এত দিনের আন্দোলনে...। এর আগের প্রশাসন যখন এলো, প্রফেসর আবদুস সুবহান ভিসি হয়ে। তখনো আমরা বললাম, এটি বাতিল করে দিতে হবে, নতুন জায়গায় নতুনভাবে করতে হবে। কেননা এটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ সার্ভ করবে না। তিনি নীতিগতভাবে রাজি হলেন কিন্তু কাজটি আর হলো না। বরং এখন আমরা দেখছি, সেটির তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিতও হলো না। যাদের চুরি-চামারির ফলে ছাদ ভেঙে পড়েছিল তারা কী করে পার পেয়ে গেল জানি না! বরং এইটাকেই আবার নতুন করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেটি জোট কখনোই চায়নি, যেটা তারা দাবি করেছিল। এইটা একদিকের ব্যাপার।
আমরা জোট থেকে আন্দোলন করেছিলাম, নাট্যকলা তারই ফল। আমরা চারুকলার আন্দোলন করেছিলাম, গড়ে উঠল, তারই ফল। এখন নাট্যকলা আর সঙ্গীত কিন্তু আলাদা হয়েছে। নাট্যকলা ও সঙ্গীতের ছেলেমেয়েরা হলে প্রাকটিস করে; গানের প্রাকটিস করতে হয়, নাটকের প্রাকটিস করতে হয়। তখন কিন্তু অন্যান্য ছাত্রদের ডিসটার্ব হয়। আমরা বলেছিলাম, ডিপার্টমেন্ট যখন খোলা হয়েছে তাহলে হলে হলে রুম করে দেন সেটার প্রাকটিস করার জন্য। যেখানে বিভাগের নাট্যকলা এবং সঙ্গীতের ছেলেমেয়েরাও প্রাকটিস করবে, অন্যদের ডিস্টার্ব হবে না। একটু দূরে সেটার রুম করে দেন। যারা গ্রুপ করে তারাও এখানে প্রাকটিস করতে পারবে। এসবের দাবি কিন্তু কোনোটাই আজ পর্যন্ত পূরণ হয়নি।
এই হচ্ছে একটা দিকের ইতিহাসের ব্যাপার। এর মধ্যে গ্যাপ দিয়ে দিয়ে অনেক কথা আছে। আমি একটু বলব, তুমি যদি সিরিয়াস হও কাজ করার জন্য, তাহলে তুমি অনুশীলন নাট্যদলে গেলে আমাদের তিরিশ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত একটা বই আছে। ‘অনুশীলন নাট্য উজান যাত্রার ত্রিশ বছর’ এই নামে। এটাতে আবু বক্কর সম্পাদনা ও গবেষণা করেছে। এখানে টিএসসির রূপরেখা আছে। বিভিন্ন পৃষ্ঠায় দেখবে, ধারাবাহিক ইতিহাস, কীভাবে এটা গড়ে উঠল। ওনার মূল আর্টিকেলে আছে। এই জিনিসগুলো আরো ডিটেইল ওখানে পাওয়া যাবে। যদি তুমি সিরিয়াস হও, ওগুলো লিখিত আকারে চাও, তাহলে ওখানে রেডিমেট আকারে পেয়ে যাবে।
প্রশ্ন : স্যার, বর্তমানে দেখা যায়, পথনাটক কিংবা নাটক করতে চাইলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয় ...
মলয় : আমি একটু বলি যে, এই বাধা নতুন নয়। বিশেষ করে বিএনপির আমলে আমরা বারবার বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিয়ে বলছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ। এবং সকল ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। এই দোহাই দিয়ে (প্রশাসন) আমরা সংস্কৃতি চর্চা করতে গিয়ে নাটকের পারমিশন চাইলে; কোনো কিছু করতে দিত না। তারপরও আমরা কিন্তু দুবার এই এমবার্গো ব্রেক করেছিলাম। তার মধ্যেও ১৯৯৪ সালেরটা ব্রেক করতে গিয়ে আমি আর এস এম আবু বক্কর কিন্তু প্রহৃত হই। এটি তখন পত্রপত্রিকায় নিউজ হয়েছিল। সংসদেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। এটি ওই বইয়ের মধ্যে ডকুমেন্ট আকারে পাওয়া যাবে। বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং ছাপা আকারে আছে। এবং আমার ওখানে ছবি আছে, ওই বইটার মধ্যে। যেটার কথা আমি বললাম। আমি পিঠ দেখাচ্ছি সাংবাদিকদের, কীভাবে পিটিয়ে পিঠে দাগ করে দিয়েছে পুলিশ। এইগুলো ভাঙতে গিয়ে। এছাড়া আমরা নানাভাবে শিবির, মৌলবাদ, ছাত্রদলের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি। আমাদের অনুশীলনের ভেতরে সব কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। আমরা তখন তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি।
তখন কিন্তু আমাদের পাহারা দিয়েছে প্রগতিশীল সব ছাত্র সংগঠন। এমনকি ছাত্রলীগ। এই ছাত্রলীগের যেমন শিখর; সে প্রাইম মিনিস্টারের দপ্তরে কাজ করে। সে ছাত্রলীগের নেতা ছিল, নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবে। আমাদের বর্তমান প্রাইম মিনিস্টারের সে হচ্ছে পলিটিক্যাল এপিএস, সাইফুজ্জামান শিখর। সে পর্যন্ত এসে বাধা (সহযোগিতা) দিয়েছে, যাতে ছাত্রদল বা শিবির আমাদের কিছু না করতে পারে। কিন্তু এই আমলে দেখছি, আমরা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বা ছাত্রলীগ নামধারীদের দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছি। এটি সব সময়ই মনে রেখো যে, আমাদের সংস্কৃতিবান্ধব সরকার। কিন্তু প্রশাসন আমাদের দিকে ঠিকভাবে না তাকানোর ফলে ...। অথচ প্রশাসনে যারা যখন গেছে, আমাদের লাইনের প্রশাসন। তারা কিন্তু বিভিন্ন আপদে-বিপদে সংস্কৃতি সংগঠনগুলোর ব্যানারেই এসে মিছিল করেছে, কাজ করেছে। এমনকি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোকে (ছাত্রলীগ) যখন নিষিদ্ধ করা হয়েছে যে, রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। তখন তারা কায়দা করে আমাদের ব্যানারে এসে দাঁড়িয়ে কাজকর্ম করেছে। অথচ আজকে সব থেকে অবহেলিত, নিগৃহীত এবং ফিজিক্যালি বারবার মার খেতে হচ্ছে প্রগতিশীল নামধারী সংগঠনের হাতে। এর থেকে তো দুর্ভাগ্য আর কিছু নেই। প্রশাসনও একই সঙ্গে নির্বিকার। এর বিচারও হচ্ছে না, কিছুই হচ্ছে না।
অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্ট-এ রয়েছে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস করতে হবে। সংস্কৃতি ছাড়া শিক্ষা হয় না কোনো দিন। তার জন্যই তো টিএসটির গল্প। পাকিস্তান আমলে, যখন আমরা স্বাধীন হইনি, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসি কেন করা হলো? তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানেও তো থাকতে হবে। একটু ভেবে দেখো, রাকসু, চাকসু যেগুলো ছাত্র সংগঠন, যার নামে ফি দেয় ছাত্র সংগঠনের ছেলেমেয়েরা এখনো। ওখানে কিন্তু নিয়ম হচ্ছে একজন পদাধিকারবলে ভিসি হবে সভাপতি, ছাত্র হবে ভিপি। সংসদের ওরকমভাবে পদাধিকারবলে সভাপতি হয়। ছাত্র হবে ভিপি, ছাত্র হবে জিএস। আর জেনারেল হবে শিক্ষক। রাকসুতেও তাই, বিভাগীয় সমিতিগুলোতেও তাই। পুরোনো বিভাগগুলোর সবগুলোতেই সমিতি আছে। প্রতিবছর নির্বাচন হওয়ার কথা। কনসেপ্টাই হচ্ছে ছাত্র-শিক্ষক। তারা এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটি করবে। সেই জায়গাটা আজকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এই কনসেপ্টা আমাদের ছেলেমেয়েরা জানেই না।
অথচ প্রতিবছর তোমরা ফি দিচ্ছো এর নামে। আর হল সংসদের নামে, রাকসুর নামে, বিভাগে সমিতির নামে চাঁদা দিচ্ছো। আবার একইভাবে টিএসটির নামে এখন চাঁদা নেওয়া হয়। অথচ সমস্ত চর্চার ক্ষেত্রে বৈরী অবস্থান। আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আমাদের পাঁচ বা ৬০০ আসনের আধুনিক অডিটরিয়াম নাই, কোনো মহড়া কক্ষ নাই। নতুন যেটা হচ্ছে, সেখানে গিয়ে দেখো জানলা-দরজা নেই, কবুতরের খোপের মতো কুচি কুচি রুম। ও দিয়ে কিচ্ছুই হবে না। এটা (সংস্কৃতি চর্চা) যেন করতে না পারে সেজন্যই বিএনপি আমলে ওটা করা হয়েছিল। অথচ ওটা বাতিলও করে নাই, নতুনভাবে করা হচ্ছে সব।
প্রশ্ন : স্যার, এই যে আমাদের বাসু দেবদার ওপর আক্রমণ করা হলো...
মলয় : আমি এই তো বলছি, টিএসসি অবহেলার...। যেহেতু অবহেলিত সাংস্কৃতিক অঙ্গন, তারই রেজাল্ট। অর্থাৎ সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে কেউই গুরুত্ব দেয়নি। তারই রেজাল্ট আমি এভাবেই দেখি ব্যাপারটিকে। তা ছাড়া এরা গুরুত্বহীন, এরা কারা এই হচ্ছে বিষয়। অথচ এরাই ক্যাম্পাসের মূল শক্তি ছিল। এরশাদ আমলে, এরশাদকে আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেই নাই। একমাত্র সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। আকাল তো লাগেনি, সে জন্য ছাত্র সংগঠনও লাগেনি ঢুকতে দেবে না। এত আমরা দাপুটে ছিলাম। আমাদের ক্যাম্পাসে ফকির আলমগীর; সে একবার ব্যান্ড শো করার চেষ্টা করেছিল। সে কিন্তু গণসঙ্গীতই গায়। আমরা স্ট্রেট বলেছিলাম যে, আমরা ফকির আলমগীরকে ব্যান্ডসঙ্গীত করতে দেব না। সে শেষ পর্যন্ত আমার কাছে এসে মাফ চেয়েছে যে, আমি আপনাদের ধারারই। কিন্তু এরা আমাকে ব্যান্ডের জন্য বলতেছে। ব্যান্সঙ্গীত আমরা কাউকে করতে দেইনি। এত শক্তি ছিল আমাদের। কিন্তু ক্রমাগত আমাদেরই লোক প্রশাসনে যায়, গিয়ে আমাদেরই ওপর চড়াও হয়। এই অবহেলার রেজাল্ট এগুলো। সার্বিকভাবে অবহেলার রেজাল্ট গান-বাজনা সাংস্কৃতিক চর্চা এগুলো তো আলাদা জিনিস; এগুলো শিক্ষা থেকে আলাদা। অথচ আজকের শিক্ষার যে মান উন্নয়ন হচ্ছে না, শিক্ষা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এগুলো চর্চার অভাবে।
প্রতিটি ছেলেমেয়েকে তার সিলেবাসের খেলাপড়ার বাইরে এক্সট্রা অ্যাকটিভিটিস করতে হবে, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্টে রয়ে গেছে। এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস না করলে সে তো মানুষের সঙ্গে কথা বলা শিখবে না। তার নেতৃত্ব পোলিশ বাড়াবে না। যা পড়ে আসবে সেটি প্রয়োগ করতে পারবে না। সেই জন্যই তো এই ব্যবস্থা। এটি আমাদের অ্যাক্টে রয়ে গেছে। হল সংসদ ওই কারণে, রাকসু ওই কারণে। নির্বাচনও হয় না, আর আমরা তো স্বেচ্ছায় নিজেরা চর্চাগুলো করছি। প্রশাসন তো করছেই না, আমরা স্বেচ্ছায় করছি সেগুলো কই!
আজকে আমাদের অডিটরিয়াম বিনা ভাড়ায় পাওয়ার কথা। দেখা যাচ্ছে, পাঁচগুণ ভাড়া দিয়ে অডিটরিয়াম নিতে হচ্ছে। ঢাকার বড় বড় অডিটরিয়ামের চেয়ে বেশি খরচ পড়ে যায়। মাইক আনতে হয় বাইরে থেকে ভাড়া করে, লাইট আনতে হয়। আবার অডিটরিয়ামের ভাড়া দিতে হয়। যার ফলে জাতীয় নাট্যশালান চেয়ে আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম অডিটরিয়ামের ভাড়া বেশি। জাতীয় নাট্যশালার ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা উইথ এসি; সেখানে লাইট আছে, মাইক্রোফোন ব্যবস্থা আছে। আর এই জিনিসগুলো, এসি বাদ দিয়ে আমি যদি লাইট আর মাইক্রোফোন বাইরে থেকে নেই, তাহলে কাজী নজরুল ইসলামের ভাড়া দাঁড়ায় হচ্ছে ২০ হাজার টাকা। কেননা ১০-১২ হাজার টাকার নিচে ভালো লাইট হয় না। মাইক্রোফোন নিতে হলে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। তাহলে এখানেই তো আমার চলে গেল ১৭-১৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ ২০ হাজার টাকার নিচে হয় না। অথচ এটা ফ্রি পাওয়ার কথা আমাদের।
প্রশ্ন : আরেকটা কথা প্রচলিত আছে যে, যখন জামায়াত-শিবির ক্ষমতায় ছিল তখন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ ছিল। যখনই কিনা আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীল সরকার ক্ষমতায় এসেছে ...
মলয় : সেটাই। ওই যে মার খেয়ে অনৈক্য ছিল। তখন দেখা যাচ্ছে, কিছু সংগঠনকে নানাভাবে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করে। তবে এই জায়গায় আমরা ব্যতিক্রম বলতে পারি। আমি সৎ পক্ষ থেকেই কথাটা বলছি, একজন অভিভাবকের জায়গা থেকে। আর যদি আমার গ্রুপের কথা বলি, কখনো কোনো ধরনের স্তাবকত্বের জায়গায় যায় নাই। তুমি যদি সম্পূর্ণ ইতিহাস দেখো, আমরা মন্ত্রী-এমপি এমনকি কোনো আমলে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে চিফ গেস্ট করে আনি নাই। আমরা এনেছি কালচারাল লোককে চিফ গেস্ট করে। আমার সংগঠনের বয়স হচ্ছে ৩৭ বছর। আমরা টাকা পাওয়ার জন্য কোনো দিন কোনো এমপিকে আনি নাই, মন্ত্রীকে আনি নাই, এমনকি ভিসিকেও আনি নাই। কেননা আমরা এতে বিশ্বাস করি না। আমরা মনে করি, ভিসি ভিসির মতো থাকতে পারেন। ভিসির পদ মর্যাদার। কিন্তু তিনি যদি সংস্কৃতির লোক হন, ওই হিসেবে আনত তাঁকে। আজকে যেমন আসাদুজ্জামান নূর আামাদের সংগঠনকে চিনেন, যেতে চান। আমি বলেছি আপনাকে আমরা মন্ত্রী হিসেবে নেব না, নাট্যজন হিসেবে আমরা নেব। বললেন, তাহলেও আমি যাব। আমরা হয়তো নেব সামনে অক্টোবরের দিকে।
প্রশ্ন : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো হয়েছে, সেগুলো জাতীয় রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে?
মলয় : জাতীয় রাজনীতিতে?
প্রশ্ন : জি।
মলয় : প্রভাব ফেলেছে বলেই তো। একটা জিনিস দেখতে হবে, বাংলাদেশের বড় বড় আন্দোলনের সূতিকাগার তো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রধান হচ্ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি, তারপরে হচ্ছে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি। আর রাজশাহী ইউনিভার্সিটির এই আন্দোলনগুলোর সমস্ত অরগানাইজ করেছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। তুমি খেয়াল করে দেখো, ২০০৭ সালে আমাকে কেন জেল খাটতে হলো? আমি তো সরাসরি শিক্ষক রাজনীতি করি না। আমি কোনো দিন ইলেকশনে দাঁড়াইনি। ওই যে, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে- এ রাস্তায় থেকেছে। যা হোক, ’৯৬ সালে জনতার মঞ্চ আমরা গড়েছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো বিএনপিকে হারিয়ে। সমস্ত আন্দোলনে কিন্তু আমরাই রাস্তায় নেমেছি। যদি রাজশাহীতে খোঁজে দেখ তাহলে দেখবে, প্রধান যে ভূমিকা তা হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোটের। শহরকেও তারা কাঁপিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়কেও তারা কাঁপিয়েছে। কাজেই জাতীয় পর্যায়ে বিরাট ভূমিকা আছে। এবং সমস্ত জাতির বড় বড় পরিবর্তনে; গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনগুলোতে সাংস্কৃতিক জোটগুলোই নেতৃত্ব দিয়েছে।
আর আজকের ছেলেমেয়েরা ইতিহাস না পড়ে হয় কি, পাস করে অনেকে বেরিয়ে যায়, নতুন আসে। কিসের শিক্ষক, ছবি দেওয়ার মতো করে তাদের বোঝায়। তারা কী করে, হঠাৎ ছয় মাস-এক বছর পরে অনুষ্ঠান হলে মঞ্চে গিয়ে বসে। জীবনে কোনো দিন খোঁজ নিতে যায় না যে, এই ছেলেগুলো কী করে। কিন্তু তুমি আমাকে প্রতিদিন পাবে যদি রাজশাহীতে আমি উপস্থিত থাকি, শুক্রবারসহ। বাংলাদেশে একমাত্র ব্যক্তি যে, এই রকম রেগুলার আমি গ্রুপে যাই, সময় দিই। সেটা আমি মহৎ থেকে দেখি না যে, আমাকে নেতা হতে হবে। আমি ছেলেমেয়েগুলোকে ভালোবাসি, এই কাজটাকে ভালোবাসি এই জায়গা দিই। কোনো অহংকার থেকে বলছি না।
প্রশ্ন : আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো, এখন নাকি সেটা স্তিমিত হয়ে আসছে?
মলয় : রাইট। স্থিমিত হয়ে আসছে, অনেক দিক থেকে। প্রধানত হচ্ছে আগে বিভিন্ন সংগঠনে অনেক শিক্ষক যুক্ত ছিলেন। তারা নিজেরা অন্যান্য কাজে এত ব্যস্ত ছিল না যে, সময় পায় না। আসলে তাদের ডিউটির কাজ ছেলেমেয়েদের সময় দেওয়া। তা না দিয়ে, যেমন আমার কলিগরা সান্ধ্যকোর্স নিয়ে ব্যস্ত, অন্যান্যরা অন্য কাজে ব্যস্ত। যার ফলে নতুন শিক্ষকরা ভুলেই গেছে যে, ওই কাজটা তাদের করানো উচিত। আমার বয়স ৬০ বছর। চাকরির বয়স ৩৪ বছর। এখনো আমি সময় দিয়ে যাচ্ছি। অথচ ওইখানে দেওয়ার কথা আমার ছাত্রর ছাত্রদের। সেই কাজটি তারা করে না। এইটার জন্যে তাদের সংগঠনগুলোর কোয়ালিটি কমে গেছে। তাছাড়া দেখবে যে, নাট্যচর্চা হলে তো তাদেরকে কেউ শেখানোর থাকতে হয়। এইভাবে তুমি যখন একট ভালো নাটক না নিয়ে দাঁড়াবে, ভালো গান না গাইবে; এদিকে মিডিয়াগুলোয় কিন্তু তুমি চাইলে মুহূর্তে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অভিনয় মোবাইলে দেখা সম্ভব। তুমি যদি তার চেয়ে বেটার না পাও যাবে কেন? কাজেই এটাও স্বীকার করতে হবে যে আমাদের বেশির ভাগ সংগঠনের অনুষ্ঠানের মান নেমে গেছে। দুই হচ্ছে, তারা বোঝেই না তাদের নেতৃত্বে ঘাটতি পড়ে গেছে। শিক্ষকরা যেহেতু সরে গেছে ওখান থেকে।
এখন আমি একটা সংগঠন করি, অন্য সংগঠনকে কে দেখবে? অনেকেই এসে অল্প কিছু না জেনেই কোনো সংগঠনের সভাপতি হয়ে বসছে, জোটের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসছে। তখন কিন্তু তার জানা-অভিজ্ঞতার চেয়ে নিজের নেতৃত্ব বোঝাটাতেই বেশি জোর দিতে হচ্ছে। দুইটাতেই আছে সে। তাতে বিভ্রান্তেও পড়ছে অনেকে। কিন্তু আগে ছিল অনেক মেচুর। আর শিক্ষকরা যুক্ত ছিল। যেমন জোটে, দুটো কর্মকর্তা একটা প্রেসিডিয়াম, আরেকটা সেক্রেটারিয়েট। প্রেসিডিয়াম মেম্বারটাতে আগে থাকত শিক্ষক। আমাদের কনস্টিটিউশন ওভাবে নয়, কিন্তু নৈতিকভাবে এটা ছিল উহ্য। প্রেসিডিয়াম মেম্বার হবে সব শিক্ষকরা। আর সেক্রেটারিয়েটে যে পদ আছে, তা হবে ছাত্ররা। তাহলে কাজটা ভালো হবে। ঠিক যেভাবে রাকসু, হল সংসদ হয়েছে। প্রেসিডিয়াম লেবেল হচ্ছে শিক্ষক, আর সেক্রেটারিয়েট লেবেল হচ্ছে ছাত্ররা। সেটি ফরম্যাট ছিল।
এখন দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকরা আসে না বলে আমি সাত বছর পরপর ছিলাম। এতে লোকে বলবে তো, আমি নেতৃত্ব পছন্দ করি। আমি থাকব না আর। আমার পরে হাসান (হাসান আজিজুল হক) স্যার এলেন, তারপরে এলেন জুলফিকার মতিন। তারপরে এলেন মো. নূরুল্লাহ; প্রো ভিসি ছিলেন। সবশেষ শিক্ষক প্রেসিডেন্ট হলেন মোহাম্মদ নাসের, স্ট্যাটিসটিক্স-এর। এই শিক্ষক শেষ। এরা তাও কিছুটা ছিলেন কিছুদিন, তারপরে কোনো শিক্ষক এলোও না, সময়ও দেয় না। ছেলেমেয়েরাও যেহেতু ওইভাবে সময় দেয় না, তাদেরকেও ওভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই ভাবেই চলছে আর কি! যার ফলে হয় কি, অভিজ্ঞতার অভাবের ফলে কোয়ালিটি কিন্তু স্থিমিত হয়ে যায়। তার কারণ ওই যে নানামুখী।
প্রশ্ন : এখন তো দেখা যায়, সাংস্কৃতিক কর্মী পর্যন্ত কমে গেছে ...
মলয় : একদম কম। অন্য দুটো কারণ। একটা হলো যে, ভালো সংগঠকও যেমন কর্মীদেরকে টানতে পারে তখন কর্মীরা যায়। দুই হচ্ছে, ছেলেমেয়েরা ইদানীং ক্যারিয়ার ক্লাব অমুক-তমুক, এই সমস্ত তো আগে ছিল না। এই সমস্ত দিকে তারা চলে যাচ্ছে। তারা ভাবছে এইখানে গেলেই বোধহয় চাকরি-বাকরি পাবে। কিন্তু তারা ভাবছে না যে, ৩৭ বছরে অনুশীলন নাট্যদল থেকে আমি পাঁচশ কর্মীদের বের করেছি। বাংলাদেশের যে যে জায়গায় আছে, সবাই নাটক করে তা না। এত উঁচু পদে তারা আছে। কেননা তাদের চোখমুখ খুলেছে। তারা কথা বলতে পারে, নিজের কোয়ালিটি বাড়িয়েছে, তারা সোশ্যাল, তারা অনেক কিছু জানে, তারা ডিসিপ্লিন। এগুলো কিন্তু তারা দল থেকে শিখেছে। আমাদের প্রত্যেক কর্মী প্রত্যেক জায়গায় ভালো আছে।
এই জায়গায় ছেলেমেয়েরা যদি আসত, তারা মানুষ হয়ে যেত। সিলেবাসের বাইরে তারা অনেক কিছু শিখত। কিন্তু এই প্রচারটা তো তাদের মধ্যে নেই। বরং উল্টো প্রচার। নতুন সদস্য হইতেছে, ক্যারিয়ার ক্লাব অমুক-তমুক। মোবাইল ফোন কোম্পানি ঢুকে তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। সংস্কৃতি চর্চা মানেই হচ্ছে অবস্থান নিতে হবে এই সব হয়ে গেছে। কনস্টিবডি, কোনো সংগঠক নেই, আর এদিকে মোমেস্তান ছেলেমেয়েদের। আমরা ওইদিকে গিয়ে সময় নষ্ট করব কেন? আমি এই দিকে চলে যাচ্ছি। কনস্টেনসহ, কুশেনটা আমার নিজের সন্তান এরও তাই। আমি সেটা অন্যকে দোষ দেব না। আমরাই করে ফেলেছি তাই। প্রাইভেট পড়িয়ে, কোচিং সেন্টারে দিয়ে দিয়ে আমরা তো তাদেরকে একেবারে নির্ভরশীল করে ফেলেছি। যার ফলে দেখো, এটি তো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে না, রাজনৈতিক অঙ্গনেও তো। আজকে ভালো রাজনীতি নেই বলেই তো এই সমস্ত চাঁদাবাজরা এসে দাঁড়িয়েছে। ভালো ছাত্ররা তো ছাত্র রাজনীতি করে না।
অথচ আমাদের সময় প্রত্যেকটা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছাত্র রাজনীতি করত। সেটিকে তারা মনে করত তাদের ডিউটি। তাদের দেশপ্রেম ছিল। আজকে আমরা ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যকর বিচ্ছিন্ন বানিয়ে ফেলেছি অভিভাবকরা। সিউর করছি তাদেরকে প্রাইভেট টিচার দিয়ে, কোচিং দিয়ে- কমার্শিয়াল। কী কমন পড়বে এইটা হলো লেখাপড়া। বিদ্যা চর্চা কি কমন পড়া? এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাটা অনেকটা সেরকম হয়ে গেছে। কারণ সার্বিকভাবে শিক্ষার ত্রুটি, ভালো সংগঠনের ত্রুটি। ছেলেমেয়েরাকে অভিভাবকরা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকে বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। শিখিয়ে দিচ্ছে যে, এই গোল্ডেন এ প্লাস পেতে হবে। গোল্ডেন এ প্লাস, সার্টিফিকেট ধুয়ে খাবে। সে কথা বলতে জানে না; আমরাই তো ক্লাসে দাঁড়িয়ে বলি, গোল্ডেন প্লাস পাওয়া ছেলে, সে কমন পড়েছে বলে গোল্ডেন প্লাস পেয়েছে। আসলে সে কিছুই জানে না। সে সাঁতার জানে না, সে ভাষণ দিতে পারে না। কোন সিজনে কোন ফল ফলে, ফসল ফলে জানে না। তাহলে গোল্ডেন প্লাসের মূল্য কী হলো? সে তো ভবিষ্যতে কিছুই করতে পারবে না। কেরানিগিরির চাকরি করতে হবে তাকে। যার ফলে সার্বিক খাতে দিয়ে, এটি বিচ্ছিন্নদের সময়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ রাজনৈতিক শূন্যতা। বাংলাদেশে ভালো রাজনৈতিক নেতা নাই।
প্রশ্ন : সাংস্কৃতিক আন্দোলন, জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব, তাদের (সংস্কৃতিকর্মী) ওপর সব মিলিয়ে অতীতের সঙ্গে যদি বর্তমানের তুলনা করে বলতেন কিছু।
মলয় : হ্যাঁ। আমি তুলনা করেই বলছি। আজকে এই যে ধসগুলো হয়েছে; তার মধ্যে যারা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিতে পারে, তাদের মধ্যে লোভ, ক্ষোভের আকাঙ্ক্ষা জন্ম হয়েছে। সেটাও একটা বিরাট ব্যাপার।
প্রশ্ন : মানে ভোগ চলে এসেছে?
মলয় : হ্যাঁ। ভোগ, লোভ এটাও আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করছে। নতুন প্রজন্মকে তো পথ দেখাতে হবে। তারা দেখছে যে, যারা পথ দেখাবে সে তার ভাবত্ব ছাড়ে না। সে কোনো পদ দেখলে ছাড়ে না। সে একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে অথবা একটি সান্ধ্য প্রোগ্রামে লেকচার বাদ দিয়ে সে তার সাথে মিশে না। তাহলে তো ছেলেমেয়েরা ওই লেজের দিকেই যাবে। তাই দায়ী আমরা, এর জন্যে।
প্রশ্ন : এখানে আশার জায়গাটা কোথায়?
মলয় : আমি বলি, এটি খুবই কষ্টের। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যদি ঘুরে না দাঁড়ায়, আমাদের জাতীয় নেতৃত্ব যদি ঘুরে না দাঁড়ায়। তাহলে কেবল মাত্র বিচ্ছিন্নভাবে সংস্কৃতি। সংস্কৃতি তো সমাজবিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আমরা কোয়ালিটি তাদের বাড়াতে পারব ব্যাপার না। এটার জন্য আমাদের জাতিকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। জাতির সর্ব সেক্টরে। বিশেষ করে শিক্ষা। প্রাইমারি শিক্ষা থেকে আমাদের নতুন ভাবনা করতে হবে। এটি খুব কঠিন কাজ। আমি কোনো সস্তা আশার কথা বলব না। তবে এটাও ঠিক, হতাশা বেশিদিন থাকে না। অন্ধকারের পর একসময় আলো দেখা যায়। মানুষ ভাবতে শিখেছে। এই যে, পিকচার কিন্তু হচ্ছে এখন কোয়ালিটি এডুকেশন হচ্ছে না। ওয়ার্ল্ডে আমরা কিন্তু নিচে নেমে যাচ্ছি। অর্থাৎ চিন্তাটা বেশ আসছে। এই চিন্তা হলেই সংস্কৃতির কথাটি এখন এসে যাবে। কাজেই এতে বেশিদিন চলতে পারে না। রাজনীতিও ভালো হতে বাধ্য হতে হবে। এটিই আশার কথা। এভাবে বেশিদিন চলে না, মানুষ একসময় ঘুরে দাঁড়ায়। সেইটাই আমি বলব, মানুষ ঘুরে দাঁড়াবেই। দাঁড়াতেই হবে নইলে জাতি টিকবে না। কিন্তু রাতারাতি ঘুরে দাঁড়াবে এমন কোনো মন্ত্র নেই।
প্রশ্ন : জুলফিকার স্যার, হাসান আজিজুল হক স্যার, আপনি এরকম তো আরো অনেকেই আছেন ...
মলয় : কিন্তু ওরাও তো রিটায়ার করে গেছে। তুমি একইভাবে দেখো যে, জুলফিকার মতিন কোনো দিন প্রভোস্ট হননি, হাসান আজিজুল হক স্যার কোনো দিন প্রভোস্ট হতে যান নাই। তারাও ছেলেমেয়েদের নিয়ে থেকেছেন। আমি তো জীবনে কোনোদিন হাউস টিউটরও হইনি, প্রভোস্টও হইনি।
প্রশ্ন : নতুন যে শিক্ষকরা আছে, এদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব আসছে না কেন?
মলয় : আসছে না ওই যে বললাম, তারা তাদের সিনিয়রদেরকেও মোহ দেখছে। তারা কী করছে, ওমুক পদ দখল করব, তারপরে সিবিং-এ (সি বিচে) ঘুরে বেড়াব। ঢাকায় যাব, ভিসি হব। অমুক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হব। টিএসসিতে যাব। আমার বলতে দ্বিধা নেই, এগুলো তো জুনিয়র শিক্ষকরা দেখছে। আমাদের সময়, আমরা তো ভাবিই নাই। এখন দেখা যায়, দুই বছর হলো জয়েন করে, তারা একটা অ্যাসোসিয়েশন করে নিয়ে বলল আমি জায়গা-জমি করব, গাড়ির চাষ করব! আমি আমাদের ছাত্র, শিক্ষক হয়ে জয়েন করেছে তাদের বলি যে, ভাই, পাঁচ-সাত বছর একটি বিশ্ববিদ্যালয় তোমরা ছেলেমেয়েদের শোনাও। তারপর বৈষয়িক চিন্তা করো। কিন্তু না, প্রথম বছর থেকেই তাদের বৈষয়িক চিন্তা। এটা আমাদের কাছ থেকে শিখছে। কয়টা লোক আছে দেখো? আমার ফ্যাকাল্টিতে একমাত্র সান্ধ্য ক্লাস নেই না আমি। অথচ এতগুলো শিক্ষক। আমি তাঁদের দায়ী করছি না। কিন্তু তাঁরা শুধু সেইটাই করবেন? একটু সময়ও ছেলেমেয়েদের দেবেন না? তারা তো দেন না।
সে ক্ষেত্রে বরং আমি সমালোচনার মুখোমুখি হই। আমি নাকি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করি। আমাকে দেখতে পারে না অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে যা লেখা আমি তাই করি। আমি তো বেতন পাই। আমি ওকে (সান্ধ্যকোর্স শিক্ষার্থীদের) পড়াতে যাব কেন? এতে আসলে আমি অনেকের আঘাতেরও শিকার, অনেকের ঈর্ষার শিকার। আমি নিজেও যে এগোবো সেখানেও নানা বাধার মুখোমুখি। কিন্তু আমি বলি একসময় এই প্রজন্ম না হোক, তোমাদের প্রজন্ম ফিল করবে। এই যে, তুমি আজকে জানলে তুমি হয়তো ফিল করছো। তোমাদেরই হয়তো কেউ, তুমি বা এ রকমই কেউ শিক্ষক হবে, তারা সময় দেবে। আমরা এই আশায় থাকব। এ ছাড়া আর কী করব বলো? আমাদের তো বয়স হয়ে গেছে। আমাদের স্বপ্ন নিয়েই, আশা নিয়েই শেষ করতে হবে।
প্রশ্ন : আপনি বলছেন, আপনাকে অনেক ঈর্ষা, বাধার সম্মুখীন হতে হয় ...
মলয় : বাড়াবাড়ি করছি কেননা আমি ওই যে বলছি, শিক্ষকদের ডিউটি এই, কিন্তু সে এটা না করে অন্যটা করতে গেছে। তার নিজের স্বার্থের দিকে গেছে। তখন ওই যে ছেলেমেয়েরা রয়েছে তাদের খারাপ লাগছে। এই লোকটা সত্য বলে দিচ্ছে। বাধা মানে ঠ্যাঙে বাড়ি দিচ্ছে তা না। যেখানেই পাচ্ছে নিন্দা করছে, অপপ্রচার চালাচ্ছে, মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রচুর এগুলো।
প্রশ্ন : শিল্পীরা তো কোনোকালেই ভালো ছিল না। বিষয়টা এ রকমই না স্যার? শিল্পীরা তো সব সময়ই খারাপ ছিল...
মলয় : সব সময়ই খারাপ ছিল। আমাদের মতো দেশ। শিল্পের কদর নেই, সুবিধাবাদীদের কদর। তারা (শিল্পীরা) সব সময়ই নির্যাতিত, নিপীড়িত হয়েছে। কিন্তু এখন আরো বেশি হয়েছে এটা। এখন তাদের আরো মানা হয় না। দেখতেই তো পাচ্ছো। ঘরের মধ্যে ঢুকে পিটিয়ে (বাসু দেব, সংস্কৃতিকর্মী) এইভাবে মেরে চলে গেল। আমি বলব, যে পিটিয়েছে তার তো কোনো বোধশক্তিই নেই। শিক্ষাই নেই তার। কাকে পেটাল সে? মানে কোনো বোধশক্তি আছে তার? এমন না যে ওই ছেলেটাকে (রাবি ছাত্রলীগকর্মী সাদ্দাম হোসেন সজীব) মারতে গিয়েছিল, তাও তো না। এই যে মূল্যবোধ ধস হয়ে গেছে তবুও আমি এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দায়ী করব না, দায়ী আমরা। আমরা তাদেরকে এই পথে নিয়ে যাচ্ছি। পথ তো দেখাচ্ছি না আমরা। তবে হয়তো তোমরা দেখাবে পথ, এই প্রত্যাশা।
প্রশ্ন : এখন আমরা দেখছি, বেশকিছু দিন হলো নাটকই হচ্ছে না আমাদের ক্যাম্পাসে ...
মলয় : সেটা সত্যি। তবে যতটুকু করার আমরা চেষ্টা করছি। আমি জানি না তুমি কতটুকু দেখো। আমাদের কিন্তু পরশু দিন একটা শো ছিল। শহীদ মিনারে ১১ তারিখে শো ছিল। দেখে ছিলা কি? আমাদের অনুশীলন নাট্যদল হিসাব করলে দেখবা যে, অতীতে যা করেছি তার চেয়ে বেশিই করছি এখন। কিন্তু শুধু আমরা একা করি বলে, অতটা চোখে পড়ছে না। অন্যদের নাই তাই। আমাদের কাজ কমে নাই। কিন্তু দুই বছর হয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে। আমি কোনো অহংকার দিয়ে বলব না। আমাদের ওখানেও কর্মী নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। থাকে না, হঠাৎ চলে যায়। কোনো দায়বদ্ধতা নেই। একটা নাটকে দ্বিতীয়, তৃতীয় শো করে ফাঁসিয়ে দিয়ে হঠাৎ করে নাই হয়ে যায়। আবার ওই জায়গায় আরেকজনকে তৈরি করতে দুই মাস সময় লাগে। এই অবস্থা, আর কী করা যাবে।
ঠিক আছে। আর ওই বইটা তুমি সংগ্রহ করে নাও। ফটোকপি করে আবার দিয়ে দাও। জিয়াদিন নাম আমার দলের সেক্রেটারির। সাড়ে ৫টার দিকে গেলে তুমি তাকে পাবে অনুশীলন নাট্যদলে। অনুশীলনের যে ৩০ বছরের প্রকাশনীটা আছে, স্যার সেটা আমাকে দিতে বলেছে, আমি একটু ফটোকপি করে নিয়ে দেবে। এই কথার অনেক কিছু ওখানে পাবে তুমি। কীভাবে টিএসসি বিপ্লব হয়েছিল, সেখানে কারা কারা ছিল। ডিটেইল সেটা দেওয়া আছে। এই রূপরেখায় আমরা কী দাঁড় করালাম। আমরা আসলে কী চাই? এতদিন আমি কী চেয়েছিলাম, আজ আমরা কি পাচ্ছি।
প্রশ্ন : স্যার, সর্বশেষ কিছু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি, সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতি এবং সারা বাংলাদেশের ...
মলয় : আমি মনে করি যে, শিক্ষা আর সংস্কৃতি বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এক অর্থে বললে, শিক্ষা, সংস্কৃতি যদি উন্নত হয় আমাদের রাজনীতিও উন্নত হবে। এক্ষেত্রে রাজনীতি যেহেতু সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে; রাজনীতি যদি ফ্রেশ না হয় শিক্ষার মানও নেমে যায় এবং সংস্কৃতিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই জন্যে আমাদের যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ, রাজনীতিবিদদেরই প্রথম ভূমিকা নিতে হবে।
আমাদের রাজনীতিবিদরাই যেহেতু দেশ পরিচালনা করবেন, সরকারে তাঁরাই যাবেন, তাঁদেরকেই বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের শিক্ষার মান কীভাবে উন্নত করা যায়। শিক্ষকরা কীভাবে প্রকৃতভাবে শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। আমার মনে হয়, যে প্রক্রিয়া আজকে অন্ধ দলীয়করণ; এই প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে শিক্ষার উঁচু পদগুলোতে কোনো ব্যক্তিকে না দেওয়া। আমি বলছি না রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষকরা ডেফিনেটলি রাজনীতি করবেন। রাজনীতি ও দলবাজি এক নয়। সেইগুলোও রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের লোভ-লালসা ত্যাগ করে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের দিকে প্রকৃতভাবে তাকাতে হবে। নাহলে কিন্তু এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব হবে না।
প্রশ্ন : মানে, উত্তরণের পথ এটাই?
মলয় : আমাদের বুদ্ধিজীবীরা তো কত বড় ভূমিকা নিয়েছে দুঃসময়ে। সেই ভূমিকায় আবার দাঁড়াতে হবে। প্রতিযোগীদের নিজেদের স্বার্থকে কমিয়ে দেশের স্বার্থ, সাধারণের স্বার্থকে নিজের স্বার্থ মনে করতে হবে। যেটা একসময় ছিল। আর রাজনীতিবিদদেরও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে হবে। আর এটা নিয়ে ভাবলে একই সঙ্গে জঙ্গিবাদকেও মোকাবিলা করাও সম্ভব হবে, সন্ত্রাসকেও মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
প্রশ্ন : আমাদের দেশের যে অবস্থা বিরাজ করছে, রাজনীতিবিদরা কি এটা নিয়ে ভাববে বলে মনে হচ্ছে? যেখানে বাসু দেবদার ব্যাপারে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না।
মলয় : আমি বলছি, এ লক্ষণ সত্যিই তাদের নেই। তারপরও তো তাদেরকেই বলতে হবে। যদি বল শেষ উপায় কী? সেখানে তো অন্যকেউ আসবে না। তাদেরকেই তো চেঞ্জ হতো হবে। চেঞ্জ নাহলে তো কোনো উপায় নেই। সমাধান তো উপর থেকে পড়বে না।
প্রশ্ন : এই চেঞ্জটা কীভাবে আসবে?
মলয় : চেঞ্জটা কীভাবে আসবে এটি খুব কঠিন ব্যাপার। এই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি একটু আগেই দিয়েছি। এটি একটি সার্বিক ব্যাপার। এটির ক্ষেত্রে জনগণেরও দায় আছে। অভিভাবকদেরও দায় আছে। আমি যদি প্রতিবছর ‘দুর্নীতিবাজ’দের লক্ষ লক্ষ ভোট দেই তাহলে দুর্নীতি কীভাবে সরাব বলো?
প্রশ্ন : নিয়মিত যদি দুর্নীতিবাজই দাঁড়ায়, তাহলে সাধারণ মানুষ কাকে ভোট দেবে?
মলয় : না, আমি ভোটই দিতে যাব না। সেটুকুও তো অধিকার আছে। কিন্তু আমি তো যাচ্ছি। কাজেই জনগণেরও একটা দায় আছে। আমাদের সাধারণ ছাত্রদেরও দায় আছে। আজকে একেবারে ক্যারিয়ার করে লাফালে, ক্যারিয়ার তো হবেই না; যোগ্যতায়ও তো ক্যারিয়ার হয়। কোথাও গিয়ে দাঁড়ালেই কি চাকরি পাওয়া যায়, ভালো হওয়া যায়। আগে তো যোগ্যতা তৈরি করতে হয়। যোগ্যতা তৈরি করতে হলে সিলেবাসের বাইরে তাকে এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটি করতে হবে। সংস্কৃতির কথা ভাবতে হবে। কিন্তু এটি সার্বিক ব্যাপার। চট করে ফল পাওয়া যাবে এমন আশা নেই। আস্তে আস্তে হলেও হয়তো প্রত্যাশা রাখি, স্বপ্ন থাকছে আমাদের। আস্তে করে হলেও একেকটা ইস্যু আসবে, ভাববে মানুষ।
এই যে আজকে বাসুদেবের ঘটনার পর যা প্রতিবাদ হলো। কালকে আরেকটা এ রকম ছেলে চট করে কারো গায়ে হাত দিতে হয়তো একটু চিন্তা করবে। এটি সামান্য অগ্রগতি হলেও হয়তো একটু অগ্রগতি। হয়তো বিচার করছে না তারা। কিন্তু বিচার আলাদা একটা প্রশ্ন, সেটা তো আমরা চাই-ই। প্রতিবাদটা তো হচ্ছে। এই প্রতিবাদটাও তো একটি অগ্রগতি। প্রতিবাদে সঙ্গে যদি ক্রমাগত সাধারণ ছাত্ররাও যুক্ত হয় এটা আমারই ভাই, সে সংস্কৃতিকর্মী মানে বিচ্ছিন্ন কিছু না। ইদানীং কেন জানি রাজনীতিবিদরা আলাদা হয়ে গেছে, ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা আলাদা হয়ে গেছে, সংস্কৃতিকর্মীরা আলাদা হয়ে গেছে, আর সাধারণ ছাত্ররা আলাদা হয়ে গেছে। মনে করে, এগুলো আলাদা কিছু। কিন্তু এগুলো অতীতে ছিল না। সেইটা হয়তো একটু একটু করে ভাববে। আশা ছাড়া আর কী করব বলো। আশা নিয়েই তো থাকতে হবে। তো ঠিক আছে থ্যাংক ইউ।
প্রশ্ন : ধন্যবাদ স্যার। স্বপ্নটাই বড় কথা...
মলয় : স্বপ্ন নিয়ে টিকতে হবে। কিন্তু অলীক স্বপ্ন দেখলে হবে না। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলাম আর নিজে কিছুই করলাম না, তা না। স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টাও করতে হবে। স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টাও করতে হবে। এটা যেন এ রকম না হয়, অমুকে করে না তাহলে আমি করব কেন? এবং সেই চেষ্টার সময় ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’এই কথাটি মাথায় রাখতে হবে।
১৮.০৬.১৫