তুলে নিল তিন, ফিরল দুই, রয়ে গেল প্রশ্ন
১৮ মে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর। নিজ ফলের দোকানে যাচ্ছিলেন আবু রায়হান মো. নুরুল ইসলাম দুলাল। পথ থেকে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর তাঁর বাসায় গিয়ে তুলে নেওয়া হয় আরো দুজনকে।
১৯ মে মুক্তি পান দুজন। এর একজন যোগ দিয়েছেন ব্যবসায়ে। অন্যজন ফিরে গেছেন গ্রামে। ‘নিখোঁজ’ থেকে যান দুলাল। খোঁজ না পেয়ে ২০ মে মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন দুলালের ভাই মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কেউই তাঁকে কিছু জানাতে পারেনি। এরপর গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে পাল্টে যায় ঘটনা।
দুলাল ছাড়াও তুলে নিয়ে যাওয়া বাকি দুজন হলেন আবুল খায়ের ও মো. মোজাম্মেল। তাঁরা তিনজনই একই বাসায় একই কক্ষে থাকতেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুলালের ভাই মোজাহিদুলের সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের প্রতিবেদকের। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আল্লাহ করিম মসজিদের উত্তর পাশে তাঁর ভাই নুরুল ইসলাম দুলালের একটি ফলের দোকান আছে। মাত্র এক মাস আগে তিনি এই দোকান দিয়ে ফলের ব্যবসা শুরু করেছেন। আবুল খায়ের নামের অন্য একজন এই ফলের ব্যবসার অংশীদার। তাঁরা দুজন মিলে একত্রে এই ব্যবসা করেন। গত ১৮ মে সকাল ৯টার দিকে তাঁর ভাই দুলাল মোহাম্মদপুর থানা এলাকার চাঁদ উদ্যান এলাকার ৬ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাসা থেকে নিজের ফলের দোকানে যাওয়ার উদ্দেশে বের হন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুজাহিদুল বলেন, প্রতিদিন তাঁর ভাই দুলাল দুপুরে নিজের বাসায় খাবার খেতে যান। কিন্তু সেই দিন বাসায় খাবার খেতে যাননি। সন্ধ্যার দিকে এক ব্যক্তি ফোন করে তাঁকে (মোজাহিদ) জানান যে, তাঁর ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছেন। এ খবর শুনে তিনি দ্রুত মোহাম্মাদপুর থানায় যোগাযোগ করেন। তবে থানা থেকে তাঁকে জানানো হয়, এই নামের কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়নি। পরে ঘটনার দুদিন পর ২০ মে মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) গ্রহণ করে পুলিশ।
মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, তাঁর ভাইকে নিয়ে যাওয়ার কিছু সময় পরই বাসা থেকে অপর দুজনকে তুলে নেওয়া হয়। এরপরের দিন আবুল খায়ের ও মোজাম্মেল নামের দুজনকে আলাদা আলাদা স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর আবুল খায়ের বাসায় ফিরে যান। আর মোজাম্মেল তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলে যান।
কেউ পূর্বশত্রুতার জেরে ভাইকে তুলে নিয়ে গেছে কি না, জানতে চাইলে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, তাঁর ভাই খুব অভাবী। কোনোমতে ব্যবসা করে নিজের খরচ চালান। এখন পর্যন্ত বিয়ে করেননি তিনি। তাঁর সঙ্গে কারো বিবাদ বা শত্রুতা থাকতেই পারে না।
সরেজমিনে গিয়ে যা জানা গেল
ঘটনা সম্পর্কে জানতে আজ সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেই ফলের দোকানে দিব্যি দোকানদারি করছেন ফিরে আসা আবুল খায়ের। কিন্তু তাঁর চোখেমুখে একটা ভয় দেখা যাচ্ছিল।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল খায়ের এনটিভি অনলাইনকে বলেন, তাঁর গ্রামের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। তিনি ঢাকায় একাই মেসে থাকেন। তাঁর স্ত্রী-সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকেন। এই মেসে মোজাম্মেল ও দুলাল তাঁর রুমমেট। মোজাম্মেলের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায়। আর দুলালের বাড়ি খুলনায়।
আবুল খায়ের জানান, দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তাঁদের দুজনকে তুলে নেওয়া হয়। ধরার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে হ্যান্ডকাফ পরানো হয় এবং একটি কাল কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। তখন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না তিনি। তাঁকে মোহাম্মদপুর থেকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা বোঝা সম্ভব ছিল না।
কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল জানতে চাইলে আবুল খায়ের বলেন, ‘অনেক ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমার পেশা, বিস্তারিত ঠিকানা এবং জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত আছি কি না, এই সব।’
আবুল খায়ের বলেন, তুলে নিয়ে যাওয়ার পরের দিন শুক্রবার তাঁকে আবার গাড়িতে করে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর তিনি জানতে পারেন, মোজাম্মেলকেও ছেড়ে দিয়েছে। শুধু নিখোঁজ রয়েছেন দুলাল।
প্রত্যক্ষদর্শী যা বললেন
এই ঘটনা সম্পর্কে দুলালের দোকানের পাশের ফল দোকানি ও প্রত্যক্ষদর্শী গোলাম মোস্তফা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ১৮ মে বিকেল আনুমানিক ৩টার দিকে মসজিদের সামনে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস রেখে ‘ধর, ধর’ বলে চারজন মানুষ দুলালকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা দুলালের হাতে হান্ডকাফ পরিয়েছিল। আর দুলালের মুখে কালো কাপড় পরিয়েছিল। এরপর তারা দুলালকে গাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। কেন দুলালকে ধরা হচ্ছে এবং তারা কে জানতে চাইলে তারা বলে, ‘আপনার কাছে জবাব দিতে হবে কেন?’
ওই ঘটনাস্থলের পাশের পলাশ মেডিকেল হলের কর্মী জিয়াউল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সে সময় আমার দোকানে অনেক কাস্টমার ছিল। তাই ব্যস্ত ছিলাম। আমার দোকানের সামনে কিন্তু চিল্লা-চিল্লি শুনে জিজ্ঞাস করলাম কী হইছে? তখন জানতে পারলাম, এখান থেকে একজনকে ধরে নিয়ে গেছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘দুলালকে নিয়ে যাওয়ার সময় আমরা জিজ্ঞাস করেছিলাম, আপনারা কে? তারা বলছে, আমরা আইনের লোক।’
মো. হানিফ নামের স্থানীয় এক ব্যক্তি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, দুলালকে তিনি অনেক দিন আগে থেকেই চেনেন। তিনি লোক হিসেবে ভালো। দুলাল তাঁর সঙ্গে সংবাদপত্রের দোকান দিয়েছিলেন। বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন আগে দুলাল একটি দুর্ঘটনার শিকার হন। সেই সময় তাঁর পায়ে সমস্যা দেখা যায়। এরপর দুলাল মাত্র এক মাস আগে ফলের ব্যবসা শুরু করেন।
হানিফ জানান, দুলালকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর শুনে তিনিও মোহাম্মদপুর থানা ও র্যাব ২-এর ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে কিছুই জানতে পারেননি।
দুলাল নিখোঁজের বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানায় করা জিডির তদন্তকারী উপপরিদর্শক (এসআই) রাজীব মিয়া গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, এই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও জানেন। তদন্ত শুরু করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।
র্যাব ২-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইফতেখারুল মাবুদ গতকাল সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মোহাম্মদপুর এলাকার এমন কোনো ঘটনা তাঁর জানা নেই।
সর্বশেষ
নিখোঁজ দুলালের ভাই মুজাহিদুল ইসলাম আজ শুক্রবার দুপরে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, গতকাল রাতে তাঁরা এক ব্যক্তির মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তাঁর ভাই হাজারীবাগ থানায় আটক আছেন। পরবর্তী সময়ে দুলালের স্বজনরা হাজারীবাগ থানায় যোগাযোগ করে জানতে পারে যে, দুলালকে গত ২২ মে আটক করেছে র্যাব-২। আর গ্রেপ্তারের পর ২৩ মে বিকেলে হাজারীবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, র্যাব ২-এর কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক পুলক চাকমা বাহিনীর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গত ২২ মে রাত পৌনে ১০টার দিকে হাজারীবাগ থানা এলাকার ভাগলপুর রহমত উল্লাহ সড়কের বাইতুর রহমান জামে মসজিদের সামনে থেকে আবু রায়হান মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম দুলালকে আটক করে। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকা বেশ কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি পালিয়ে যায়। আটকের সময় দুলালের কাছে থেকে ১৯টি লিফলেট জব্দ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি নিজেকে হিযবুত তাহরীরের সদস্য হিসেবে স্বীকার করেছেন। তাঁরা বর্তমান শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সদস্য সংগ্রহ করার জন্য এই সব লিফলেট বিতরণ করেন।
মামলার এজাহারে দুলাল ছাড়াও আরো অপর আসামিরা হলেন সালেহ আহমেদ, ইব্রাহিম খলিল প্রমুখ।