অগ্রন্থিত ছফা
ধনতন্ত্রের নবপর্যায় ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা
ভূমিকা : সলিমুল্লাহ খান
আহমদ ছফা যে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ পরিচয়েও নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ছিলেন না তাহার প্রমাণ নিম্নে মুদ্রিত ‘ধনতন্ত্রের নবপর্যায় ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা’ নিবন্ধেও পাওয়া যাইতেছে। নিবন্ধটি লেখা হইয়াছিল ১৯৯৪ সালের শেষদিকে। ইহার প্রথম প্রকাশ সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকার ১৬ অক্টোবর ১৯৯৪ সংখ্যায়। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ‘নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ’ নামক প্রবন্ধ সংকলনেও ইহার স্থান হয়। এই নিবন্ধে তিনি বর্তমান দুনিয়ায় বাংলাদেশের আত্মবিকাশ তথা আত্মরক্ষার পথ কি তাহা নির্দেশ করিয়াছেন। বর্তমানে আহমদ ছফা রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডে ইহা পাওয়া যাইতেছে।
রচনাবলি সংস্করণের সহিত পত্রিকায় ছাপা সংস্করণের কিছু গরমিল আছে। ইতিহাসের খাতিরে আমরা এখানে সাপ্তাহিক ‘রোববার’ হইতে নিবন্ধটির পুনর্মুদ্রণ করিতেছি। তবে দুই সংস্করণের পাঠে যেখানে যেখানে প্রভেদ আছে তাহাও যথাসাধ্য নির্দেশ করিয়াছি। রচনাবলি সংস্করণে যে সকল কথা আছে অথচ ‘রোববার’ সংস্করণে নাই সেগুলি তৃতীয় বন্ধনীযোগে দেখানো হইতেছে। ব্যতিক্রমের মধ্যে, রচনাবলি সংস্করণে মুদ্রিত শিরোনামায় ব্যবহৃত ‘বর্তমান’ শব্দটি আমরা এখানে বর্জন করিয়াছি। যে সকল কথা রচনাবলি সংস্করণে পাইতেছি না অথচ পত্রিকা সংস্করণে আছে সেগুলিতে প্রথম বন্ধনী দেওয়া হইতেছে। আর যে সকল কথা আমি নিজে যোগানো কর্তব্য মনে করিয়াছি সে সকলের পাশে তৃতীয় বন্ধনী দুইবার দিয়াছি।
আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, ১৯৯০ সালের পর পৃথিবীর ইতিহাস একটা নতুন পর্বে প্রবেশ করিয়াছে। এই পর্বের নাম সাংবাদিকরা রাখিয়াছেন ‘বিশ্বায়ন’ বা এই জাতীয় কিছু শব্দবন্ধে। ইহাতে উচ্ছ্বাসের প্রমাণ আছে বৈকি! আহমদ ছফা যে এই ঘটনাকে ‘ধনতন্ত্রের নবপর্যায়’ নামে চিহ্নিত করিয়াছিলেন তাহা কম শ্লাঘার কথা নয়। ধনতন্ত্রের এই পর্ব ধনতন্ত্রকে ছাড়াইয়া যায় নাই। তবে এই পর্বে ধনতন্ত্রের মধ্যে ধনতন্ত্রের মতন আরও নতুন ঘটনা ঘটিয়াছে। আহমদ ছফা তাহার একটা হিসাব করিয়াছেন।
কেহ কেহ মনে করিয়াছিলেন, পরাধীন দেশ স্বাধীনতা পাইলে ধনতন্ত্রের পথে কাঁটা বসাইবে। কার্যত দেখা গিয়াছে নব্যস্বাধীন দেশের স্বাধীনতা ধনতন্ত্রের পথে কার্যকর কোন বাধ সাধে নাই, বরং সে পথ কুসুমে কুসুমে ছাইয়া দিয়াছে। এই যুগে পুঁজির গুরুত্ব আড়েদৈর্ঘ্যে আর ঘনত্বে সবদিকেই বাড়িয়াছে। এয়ুরোপে মহাযুদ্ধ শেষ হইবার পর ধনতন্ত্রের যে নবপর্যায় শুরু হইয়াছিল, বলা যাইতে পারে ১৯৯০ সালের পর আরও বিকাশ ঘটিয়াছে সেই পর্যায়েরই। এয়ুরোপিয়া সাম্রাজ্যগুলির অনেক পুরানা উপনিবেশ বা কারবারের দেশ এখন ধনতন্ত্রের নতুন নতুন লীলাভূমি বা বিনিয়োগক্ষেত্র হইয়াছে। ইহাকে নবপর্যায় ধনতন্ত্র বিকাশের প্রথম নিয়ম বলা যাইতে পারে।
নতুন ধনতন্ত্রের আরেক নিয়ম খোদ সাবেক উপনিবেশ বা নতুন জাতীয় রাষ্ট্রগুলির বিকাশে তারতম্য বা অসম বিকাশ। এই দুই নিয়মের মধ্যে কখনও সংঘাত দেখা দিতে পারে, আবার বোঝাপড়াও হইতে পারে কখনও কখনও। প্রথম নিয়ম অনুসারে- ধরা যাক- বাংলাদেশে মার্কিন কিম্বা জাপানি পুঁজি আসিবে আর আসিয়াই জামাই আদর দাবি করিবে। দ্বিতীয় নিয়ম মাফিক ভারতীয়, পাকিস্তানী, কি মালব্য পুঁজির পদভারেও বাংলাদেশ কাঁপিতে পারে। আহমদ ছফা চাহিয়াছিলেন, বাংলাদেশে স্বাধীন (অপরাধীন নহে এই অর্থে) এক শ্রেণীর পুঁজিপতি গড়িয়া উঠুক। এই আশার গুড়ে আপাতত মনে হয় বালি পড়িয়াছে। তাঁহার আশা পরাজয় বরণ করিয়াছে।
তবে সব আশা বিফলে যায় নাই। তিনি ১৯৯৪ সালে যে অন্য ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন- আজ কিছু বেশি বিশ বছর পর- দেখা যাইতেছে সে ভবিষ্যদ্বাণী বহুল পরিমাণে ফলিয়া গিয়াছে। বাংলাদেশের উপর ভারতীয় পুঁজির ক্রমবর্ধমান আধিপত্যে তাহার প্রমাণ। কিন্তু আহমদ ছফা যে প্রস্তাব দিয়াছিলেন তাহাতে কল্পনাশক্তির উর্বরতাও কিছু কম ছিল না। ভারতীয় পুঁজির সহিত লড়িবার জন্য তিনি আমাদের দূরদেশী (ধরা যাক মার্কিন, জাপানি বা এয়ুরোপিয়া) পুঁজির জন্য ফরাশ পাতিতে বলিয়াছিলেন। দেখা যাইতেছে, এই লড়াই বড় জমে নাই। বিদেশি পুঁজির মালিকরা এখানে তিনি যেমন আশা করিয়াছিলেন তেমন পঙ্গপালের মতন ছুটিয়া আসেন নাই। অন্যদিকে বাংলাদেশের পুঁজিপতি শ্রেণীর একাংশ অবশ্য ইতিমধ্যেই ভারতীয় পুঁজির কনিষ্ঠ শরিকে পরিণত হইয়াছে।
আহমদ ছফা ভারতীয় পুঁজির মোকাবেলায় অন্য জাতীয় পুঁজির পথ পরিষ্কার করিতে চাহিয়াছিলেন। পথটা মনে হইতেছে অলীক পথই ছিল। তাই তাঁহার রোদন অরণ্যে হারাইয়া গিয়াছে। কোন কোন জাতির পুঁজিপাটা না থাকিতে পারে, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় খোদ পুঁজির একটা না একটা জাতীয়তা থাকে। সে জাতীয়তা গোপন করা যায় না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন পুঁজির লড়াই চলিতেছে। সে লড়াইয়ে ভারতেরই হয়তো জিত হইবে। ক্ষমতার জগতের মতন অর্থজগতেও কিন্তু শেষ কথা বলিয়া কোন কথা চলে না। কেননা অর্থই যে সমস্ত অনর্থের মূল সে কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।
১
[বর্তমান সময়ে] ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প নেই। ধনতান্ত্রিকতাবাদের ইতিহাস পর্যালোচনার অবকাশ এখানে অল্প। আমি ধনতান্ত্রিকতাবাদকে আমাদের দেশের ঝুরিনামা বটগাছের মত দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। বটগাছ কাণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে চারপাশে ঝুরি নামিয়ে দেয়। ঝুরিগুলো মাটি স্পর্শ করার পর মাটি থেকে মূল গাছে রস চালান করতে থাকে। এভাবে একটা সময়ে ঝুরিগুলো মোটা হয়ে একেকটা কাণ্ডের আকার ধারণ করে। মূল [কাণ্ড] মারা যাওয়ার পরও বটগাছ এই সহায়ক ঝুরিকাণ্ডের উপর নির্ভর করে দিব্যি বহাল তবিয়তে শত শত বছর বেঁচে থাকে।
ধনতন্ত্রের প্রথম উদ্ভব হয়েছিল ভেনিস, জেনোয়া, লিসবন, ফ্লোরেন্স এই সকল ইউরোপীয় শহরে। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির অগ্রগতির দ্বিতীয় ধাপে ধনতন্ত্র নতুন বেগ এবং গতি অর্জন করে। লন্ডন, প্যারিস, আমস্টারডাম, বার্লিন এই সকল নগরী ধনতন্ত্রের বিশ্বকেন্দ্র হিশেবে প্রতিষ্ঠা অর্জন করে। শিল্প-বিপ্লবের সঙ্গে ধনতন্ত্রের সংযোগ ঘটে। [এই একটা পর্যায়ে ধনতন্ত্র এবং উপনিবেশবাদ প্রায় সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়ায়।] এই ধনতন্ত্র বিশ্বব্যাপী ব্যাপ্তি অর্জন করতে বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হয়নি। কার্ল মার্কস ধনতন্ত্রের ধারক-বাহক বুর্জোয়া শ্রেণী সম্পর্কে কম্যুনিস্ট মেনিফেস্টোতে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, বুর্জোয়ারা সমুদ্র মন্থন করেছে, গিরি লংঘন করেছে, রূপার গুলিতে চীনের মজবুত পাথুরে প্রাচীর পর্যন্ত ঝাঁজরা করে ফেলেছে।
ধনতন্ত্রের ক্রমাগত অগ্রযাত্রার পথ কুসুমাস্তীর্ণ হতে পারেনি। কার্ল মার্কসের বিপ্লবী তত্ত্বে [দেখান হয়েছে], শোষণই হচ্ছে পুঁজির মূল [রহস্যের] হেতু। এই চিন্তা ক্রমাগত কেলাসিত হয়ে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছুল যে বিশ্বের জ্ঞানীগুণী মানুষ এবং রাষ্ট্রবেত্তাদের একদল মনে করলেন, পুঁজিবাদী পন্থা শোষণভিত্তিক সমাজের জন্ম দেয়। এই শোষণভিত্তিক সমাজের অস্তিত্ব নির্মূল করে সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নতুন আর একটি সমাজের ভিত্তি নির্মাণ করা সম্ভব। প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯১৭ সালে রুশদেশে বলশেভিক পার্টি লেনিন-ট্রটস্কির নেতৃত্বে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্ম দিল। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্র [জন্ম নেওয়ার] পর দুনিয়াব্যাপী একটা আলোড়ন চলতে থাকল। শিল্পী, লেখক, বিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রতত্ত্ববিশারদরা অনুভব করতে লাগলেন, পুঁজিবাদের পথ অনুসরণ না করেও সরাসরি (সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়ে) একটি শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এশিয়া আফ্রিকাসহ লাতিন আমেরিকার দেশ যেগুলো ঔপনিবেশিক শোষণ এবং নিপীড়নে পিষ্ট হচ্ছিল তাদের অধিকাংশই সমাজতান্ত্রিক সমাজকে তাদের সবরকম অভাব-অভিযোগ এবং পশ্চাদপদতা মোচনের মুশকিল আসান বলে মনে করতে থাকল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর চীনে যখন কম্যুনিস্টরা ক্ষমতা দখল করে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপরেখা দাঁড় [করাল], তারপর থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ এবং ধনতান্ত্রিক সমাজের মধ্যবর্তী দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা, ঠাণ্ডা লড়াই, স্নায়ুযুদ্ধ ঘনীভূত হতে থাকে। কেননা চীন, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ এবং কিউবা ও ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আওতায় চলে এসেছিল। পৃথিবীতে এই বিবদমান ধারার মধ্যে কোনটি প্রাধান্য বিস্তার করবে তা নিয়ে অনুমান, বিতর্ক ও বাকবিতণ্ডার অন্ত ছিল না। ১৯১৭ থেকে শুরু করে ১৯৯০ সালে যখন সোভিয়েত রাষ্ট্রের ভাঙ্গন ঘটে- সেই সময়টি ছিল ধনতন্ত্রের জন্য সব চাইতে সংকটময় কাল। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর ধনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন, চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার- এই সকল ঘটনা একযোগে মানুষের চিন্তার উপর একটা প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে। আর সেটা হল এই- সমাজতন্ত্রের আপাতত কোন ভবিষ্যৎ নেই। (মেনে নেয়া গেল সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যত নেই।) কিন্তু শোষণভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই আদর্শ ব্যবস্থা? সেটা কি বিনাবিচারে মেনে নিতে হবে?
পৃথিবীর ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে বিকশিত হচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবী নতুন এক কক্ষপথে প্রবেশ করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতন ঘটেছে এবং পুঁজিবাদের জয় হয়েছে- একথা সত্য। কিন্তু তার চাইতেও বড় সত্য হচ্ছে পৃথিবী আর একটি নতুন কক্ষপথে চলতে শুরু করেছে। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী মানব-সাধারণের পারস্পরিক সম্পর্কও এই ধনতন্ত্রের নব্য অভিযাত্রার অভিঘাতে অনেকখানি বদলাতে বাধ্য।
২
উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ধনতন্ত্র বাংলাদেশে কিভাবে বিকশিত হবে সেটা একটা আকর্ষণীয় ভাবনার বিষয় হতে পারে। বাংলাদেশে পুঁজি সঞ্চয়নের হার যতই স্বল্প হোক না কেন, [এদেশ] চরাচরপ্লাবী ধনতন্ত্রের স্রোত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে অতীতে পারেনি, ভবিষ্যতেও যে পারবে না সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে পুঁজির পরিমাণ এত স্বল্প যে সে মেরুদণ্ড সোজা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। বিদেশি পুঁজি না এলে দেশের জেলেরা সমুদ্রে মাছ আহরণ করতে পারে না, মাঠের লবণ বাজারজাত করতে পারে না, পোশাক শিল্পের চালান বন্ধ হয়ে যায়। জয়েন্ট ভেনচারের নামে যে জিনিশ এখানে হালে চালু হয়েছে আসলে সেটা হল একটা পঙ্গুলোকের ক্রমাগত আছাড় খাওয়ার ইতিহাস। বাংলাদেশের (জয়ীফ) পুঁজি থিতু হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। তাই বিদেশ থেকে যখন পুঁজি আসে দুই বগলের তলায় লাঠি হিশেবে তাকে ব্যবহার করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে সে। বাংলাদেশে যে ধনতন্ত্র হালে বিকশিত হচ্ছে তার হাত-পা [মু-মস্তক] সবকিছুই নকল এবং ধার করা। কথাটা নিষ্ঠুর এবং সত্য। তা সত্ত্বেও আমি মনে করি এখানে ধনতন্ত্র বিকাশের একটি চমৎকার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে আছে।
পুঁজির প্রসার এখন বিশ্বব্যাপী। সমুদ্রস্রোতের মধ্যে ঝড়ের তাড়নায় কোন একটি অংশের পানি যদি সরে যায় অন্যান্য অংশের পানি তীব্রবেগে এই শূন্যস্থান পূরণ করতে ছুটে আসে। পুঁজির ব্যাপারটিও অনেকটা সে রকম। কোথাও যদি বিনিয়োগের ক্ষেত্র থাকে পুঁজি অনিবার্য গতিতে সেখানে ছুটে আসে। পুঁজির দেশ কাল ধর্ম জাত কিছুই নেই। পুঁজিকে পুরুষ মানুষের জননেন্দ্রিয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। পুরুষ জননেন্দ্রিয় যেমন স্ত্রী জননেন্দ্রিয়ের সংস্পর্শে না এলে বংশবিস্তার করতে পারে না তেমনি পুঁজি যদি লগ্নি করার ক্ষেত্র না পায় পুঁজির বাড়বৃদ্ধি ঘটে না।
বাংলাদেশে পুঁজি আসছে, পুঁজি আসবে। এর ব্যত্যয় হতে পারে না। এখানে একটা রহস্যের ব্যাপার আছে- সে জিনিশটি বিশদ করতে চেষ্টা করি। (বাংলাদেশে পুঁজি দুদিক থেকে আসছে।) উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশসমূহ থেকে পুঁজির একটা ক্ষীণস্রোত ধীরে হলেও বাংলাদেশের দিকে বইতে আরম্ভ করেছে। অন্যদিকে ভারত বাংলাদেশের নিকটবর্তী বৃহৎ একটি দেশ। সাম্প্রতিককালে ভারতে পুঁজির বিকাশ একটি নির্দিষ্ট স্তর অতিক্রম করেছে। বিজ্ঞান, কৃৎকৌশল আর যন্ত্রশিল্পেও ভারত অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ভারতবর্ষের ক্রমপ্রসরমান পুঁজির যে অভিযাত্রা বাংলাদেশ তাঁর একটি প্রধান প্রয়োগক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দুই দেশের রাজনৈতিক বৈরিতা পুঁজির চলাচল প্রতিহত করতে পারেনি। দুটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক অবন্ধুসুলভ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ভারতীয় পুঁজির পরিমাণ এখন বিগত এক দশকের মধ্যে চারগুণেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। এই হারে চলতে থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াবে যে ভিন্ন ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশ ভারতের একটি ‘সাবসার্বিয়েণ্ট ইকনমিক জোনে’ পরিণত হবে।
বাংলাদেশ ধনতন্ত্রের কোন ধারাটি গ্রহণ করবে সেটা নির্ভর করছে এদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার উপর। জনগণের আকাঙ্ক্ষা বলতে আমি [বাংলাদেশ রাষ্ট্রের] পলিটিকাল উইল (Political Will) বোঝাতে চাইছি। ধরে নিলাম ভারতের ক্রমপ্রসরমান ধনতন্ত্রের ধারাটি বাংলাদেশ কবুল করে নিল। তারপর কি ঘটতে পারে? বাংলাদেশের যে সকল উঠতি ধনী (এখন পুঁজির বিকাশের জন্য মরণপণ লড়াই করছে তারা) ভারতীয় পুঁজির কনিষ্ঠ অংশীদারে পরিণত হবে, তাদের নিজেদের বিকাশের তাগিদে ভারতীয় পুঁজিকে নিমন্ত্রণ করে আনবে এবং রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জের হাট আড়ত গঞ্জ সর্বত্র ভারতীয় পুঁজির বিচরণক্ষেত্রে পরিণত হবে। এক দশক, দুই দশক এই প্রক্রিয়াটি চললে আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এই দুটি শব্দ অর্থহীনতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। আমরা ভারতের পুঁজিপতিদের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ঢুকে যাব। নিজেদের [জাতিগত] উত্থানের কোন সুযোগ থাকবে না। অথচ ভারতের অন্যান্য রাজ্যের জনগোষ্ঠী ভারতে গণতন্ত্রের যে সুযোগসুবিধা ও অধিকার ভোগ করে সেগুলো আমরা ভোগ করতে পারব না।
এখন কথা দাঁড়াল, ভারতীয় পুঁজির অনুপ্রবেশ বন্ধ করে বিশ্বপুঁজিকে যদি এখানে আমন্ত্রণ করে আনি তাহলে কি পরিস্থিতিটা ভিন্নরূপ দাঁড়াবে? পুঁজির সঙ্গে অবশ্যই বাধ্যবাধকতার প্রশ্নটা জড়িত। জাপান, কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর পুঁজির আগমন এখানে অবাধে ঘটতে দিলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা ভারতীয় পুঁজির অনুপ্রবেশের চাইতে কেন ভিন্ন ফল প্রসব করবে সে কথাটা একটু বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে।
ভারতীয় পুঁজি (এই) সবেমাত্র বিশ্বের বাজারে প্রতিযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তার কৈশোর সবে উত্তীর্ণ হয়েছে। এখনও পূর্ণ যৌবন আসেনি। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও ভারত বাংলাদেশের পরে সবচাইতে দরিদ্র দেশ। ভারতের শতকরা ৫০ ভাগ লোক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। ভারতে বৃহৎশিল্পের ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশটি পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। তা সত্ত্বেও ভারতে ঘুটের যুগ এখনও শেষ হয়নি। এই যে বিকশমান ভারতীয় পুঁজি তার চরিত্রটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর হতে বাধ্য। এখানে ভারতীয় পুঁজি অনুপ্রবেশ করতে দেই তো আমরা ভারতের (সর্বপ্রকারের) অধীন একটি [উপ]অঞ্চলে রূপান্তরিত হব। নিজেদের স্বাধীন সত্তা বলে কিছুই থাকবে না। বর্তমানে ভারত রেলওয়ে ট্রানজিট, বন্দরের সুবিধা, গ্যাস সরবরাহসহ যে সকল প্রস্তাব দিচ্ছে- একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে [প্রতীয়মান হবে]- সেগুলো ভারতের ক্রমপ্রসরমান ধনতন্ত্রের পরিপূরক ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপরেও ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন না [করতে] বলা উচিত হবে না। [ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। মুক্তিযুদ্ধে ভারত অনেক সাহায্য করেছে। তাছাড়া ব্যাপারটা ধনতান্ত্রিক বিকাশের] (কারণ দোরবন্ধ নীতি সবসময়ই ধনতন্ত্রের) পরিপন্থী।
ধরুন, আমরা ভারতের মারুতি কোম্পানিকে বললাম, আপনারা এখানে গাড়ি তৈরির কারখানা বানান। আমাদের শ্রমিকদের দক্ষ করুন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করুন, আমাদের বাজারের চাহিদা মোতাবেক গাড়ি সরবরাহ করুন এবং বাদবাকি আপনারা বাইরে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করুন। সেক্ষেত্রে ভারতীয় শিল্পপতির যুক্তি হবে, এখানে নতুন করে শিল্প বসালে গাড়ি তৈরি করতে যত ব্যয় হবে তারচেয়ে ঢের কমদামে আমাদের কারখানার তৈরি গাড়ি আপনাদের সাপ্লাই দিতে পারি। আপনারা গাড়ি আমদানি করুন, অনেক কমদামে আপনাদের দেব। খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব ঘটলে আমাদের রিটেইলার দেব। কোন অসুবিধা হবে না। আপনারা যারা গাড়ি বিক্রি করবেন তারা ভারতীয় গাড়ি অনেক সহজে এবং সুবিধাজনক দামে পাবেন। আপনাদের মুনাফার পরিমাণ কখনও কমবে না। সে গ্যারাণ্টি আমরা দেব।
জাপানি কিংবা আমেরিকান কোন কোম্পানিকে আমরা যদি বলি বাংলাদেশে আপনাদের বিনিয়োগের উর্বরক্ষেত্র রয়ে গেছে, আপনারা সস্তায় শ্রমিক পাবেন, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করে নিতে পারবেন, আপনাদের নির্মাণব্যয় অনেক কম হবে, বাংলাদেশে কল-কারখানা স্থাপন করলে বিশ্বব্যাপী আপনারা যে প্রতিযোগিতা করছেন তাতে অনেকখানি লাভবান হতে পারবেন, [তারা শুনবেন]। পশ্চিমা পুঁজিপতিদের ভালভাবে বোঝালে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে এখানে পুঁজি বিনিয়োগ করতে ছুটে আসবেন। ব্যাপক আকারে এখানে পশ্চিমা পুঁজি বিনিয়োগ হলে চীনের পেটে তাইওয়ানের মত, জাপানের নাকের ডগায় কোরিয়ার মত, অথবা দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুরের মত এখানে ভারতের প্রতিস্পর্ধী একটি পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিকাশ লাভ করবে।
একটি সাম্প্রতিক জরিপের কথা বলি। বাংলাদেশ সরকার ইউনিডোকে (UNIDO) কম্পিউটার সফটওয়ার রপ্তানির সম্ভাবনা বাংলাদেশে আছে কিনা, এ বিষয়টি যাচাই করে দেখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ইউনিডো সে জন্য এক মার্কিন কোম্পানিকে জরিপ করে দেখার জন্য নিয়োগ করেছিল। এই কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক মরিসন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং খাতির হয়েছিল। তিনি সেই সুবাদে দিল্লি, কলকাতা, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান এইসব [শহরের] দেশের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ করে যে রিপোর্টটি লিখেছেন অনুগ্রহ করে তার একটি কপি আমাকে পাঠিয়েছেন। কম্পিউটার সফটওয়ার রপ্তানির ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা বাংলাদেশে আছে সেগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করতে তিনি কুণ্ঠিত হননি। কম্পিউটার শিল্পের মৌল কাঠামো [স্থাপনের] এবং নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা বাংলাদেশের অল্পই আছে। অনেক নেতিবাচক মন্তব্যের পর মরিসন সাহেব মোক্ষম কথাটি বলেছেন। সফটওয়ার ডেভলপ করতে তাইওয়ানে লাগে পাঁচ ডলার, সিঙ্গাপুরে সাড়ে চার ডলার, ভারতবর্ষে সাড়ে তিন ডলার এবং বাংলাদেশে লাগবে দুই ডলার। এই অল্প মূলধনে অধিক লাভ করার জন্য পৃথিবীর পুঁজিপতিরা এখানে পঙ্গপালের মত ছুটে আসবে।
কিন্তু কতগুলো বাধা আছে। এখানে উৎপাদনের একটা পরিবেশ এখনও সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। হরতাল এবং কর্মবিরতি ইত্যাদি উৎপাদনবিরোধী যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখানে গড়ে উঠেছে সেটা বিদেশি পুঁজি আসার অনুকূলে নয়। এখানে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিদেশি পুঁজি আসার অন্যতম প্রতিবন্ধক। তাছাড়া ভারতবর্ষের কথাও মনে রাখতে হবে। এই বৃহৎ দেশটি তার কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী একটা জনমত সৃষ্টি করতে সবসময় এমনভাবে তৎপর যে তারা প্রমাণ করতে চায় একটা সভ্য সমাজ এখানে সৃষ্ট হয়নি। এখানে ভদ্রলোকের প্রাণ, সম্পদ, জানমাল কিছুই নিরাপদ নয়।
ভারতবর্ষের এই ব্যাপক প্রচারণার ধূম্রজাল ভেদ করে বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ সম্বন্ধে একটি অস্তিবাচক প্রচারাভিযান বাংলাদেশ কখনও করতে নামেনি। বাংলাদেশের সে ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের দূতাবাসগুলো পেটমোটা কর্মচারীদের বিহারক্ষেত্র। আমলারা অনেকেই দেশপ্রেমহীন, রাজনীতিবিদরা নাবালক এবং হ্রস্বদৃষ্টিসম্পন্ন। অনেক সময় নাকের ডগাটি দেখার ক্ষমতাও তাদের নেই। বিশ্বব্যাপী যে সকল বাঙ্গালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাতৃভূমির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করার জন্য তাদের কর্তব্য হবে [এখানে যে একটি পুঁজি বিনিয়োগের [চমৎকার] ক্ষেত্র যে আছে সে জিনিশটি উজ্জ্বল করে দেখানো।] (এখানে পুঁজি বিনিয়োগের যে একটি উজ্জ্বল ক্ষেত্র আছে সে জিনিশটি উন্নত গণতান্ত্রিক দেশসমূহের জরিপশীল লোকদের সামনে উজ্জ্বল করে তোলা।)
৩
আমি বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। দেখাতে চেষ্টা করেছি, ধনতন্ত্র যেখানে ঝুরি প্রসারিত করে সেখানে ঝুরি কাণ্ডে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়ায় সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, তাইওয়ান এই সমস্ত দেশে ধনতন্ত্রের ঝুরিগুলো কাণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে একটি ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে, বটগাছের সমস্ত ঝুরি যেমন কাণ্ডে পরিণত হয় না তেমনি ধনতন্ত্রের অনুপ্রবেশের সমস্ত প্রক্রিয়া ধনতন্ত্রের বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে না। যে সমাজে বা রাষ্ট্রে এই পুঁজি অনুপ্রবেশ করে শোষণের হাতিয়ার হয় সেই সমাজের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাটি যদি এই অনুপ্রবিষ্ট পুঁজির গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার একটা পদ্ধতি বেধে না দেয় সেখানে পুঁজি আসবে, শোষণ চলবে, কিন্তু সমাজের পুঁজিতান্ত্রিক উত্তরণ ঘটবে না।
বাংলাদেশে পুঁজি অনুপ্রবেশের দুয়ার উন্মুক্ত হয়েছে বটে কিন্তু তার পাশাপাশি এখানকার অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি আত্তীকরণ করার একটা কর্মকাণ্ড যদি সৃষ্টি করা না হয় তবে এখানকার পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের সম্ভাবনাটি মাঠে মারা যাবে। এটি রাষ্ট্রের কাজ। রাষ্ট্রকে নির্ধারণ করতে হবে কোন ধরনের পুঁজিকে আমন্ত্রণ করে আনতে হবে। আমাদের স্থানীয় পুঁজির সঙ্গে তার সম্পর্কের স্বরূপটি কি হবে। এর একটি পূর্ণ পরিকল্পনা থাকতে হবে।
আমরা বলেছি, ভারতের পুঁজির বিকাশ একটা স্তরে পৌঁছেছে এবং সেই পুঁজি বাংলাদেশে হানা দিয়ে প্রবেশ করছে। একইভাবে ভারতের মত এত ব্যাপকভাবে না হলেও পাকিস্তানেরও দ্রুত একটা বিকাশ ঘটছে এবং পাকিস্তানী পুঁজি ভারতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখানে ঢোকার চেষ্টা করছে। ভারতের পুঁজির একটা সুবিধা আছে। ভারত বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী। সীমান্তরেখা অতিক্রম করলেই পুঁজি ছুটে আসতে পারে। অন্যদিকে পাকিস্তানী পুঁজির ভিন্নরকম একটা সুযোগ রয়েছে। এই দেশটি পাকিস্তানের অংশ ছিল এবং [এটি] মুসলিম-প্রধান দেশ। ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানী পুঁজির একচ্ছত্র বিচরণক্ষেত্র। স্বাধীনতার ত্রিশ বছর পরও পাকিস্তানী পুঁজির প্রবাহের খাতটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। পাকিস্তানী পুঁজি আবার প্রবেশ করার জন্য পা ঠুকছে।
ভারতের পুঁজি যদি আবার বাংলাদেশে আসে এবং সম্পর্কটি যদি স্থায়ী হয়ে যায় বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থাটা দাঁড়াবে ভিন্নতর রাষ্ট্রিক এবং ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে বিভাগপূর্ব আমলের মত। আগে বাংলাদেশ ছিল কলকাতার শিল্প-কারখানার কাঁচামালের যোগানদার এবং অর্থনৈতিক পশ্চাদভূমি। নির্বিচারে ভারতীয় পুঁজি বাংলাদেশে এলে বাংলাদেশকে আবার ভারতীয় অর্থনীতির পশ্চাদভূমির ভূমিকায় [ফেরত] যেতে হবে।
পাকিস্তানি পুঁজি এলেও অবস্থা একই রকম দাঁড়াবে। গোটা ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানি অর্থনীতিতে পশ্চাদভূমি। ভিন্নতর পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশকে পশ্চাদভূমির ভূমিকায় ফেরত যেতে হবে। বাংলাদেশের একটি পছন্দবোধ, একটি রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা এবং অর্থনেতিক উন্নয়নের কর্মসূচি যদি না থাকে অবশ্য অবশ্যই ভারত কিংবা পাকিস্তানের অনুগত অর্থনৈতিক এলাকায় পরিণত হওয়ায় ভাগ্যকে বরণ করতে হবে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশের সামনে একটি বিকল্প এসে হাজির হয়েছে। তা হল আন্তর্জাতিক ধনতন্ত্রের পুঁজি যেভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে তাকে অবাধে প্রবেশ করতে দেয়া এবং পুঁজি অনুপ্রবেশের সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা। এটা জানা কথা, ধনতন্ত্র কায়েম হয়ে বসলে চক্রবৃদ্ধি হারে শোষণের ঝুরি প্রসারিত করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাজ হবে এই ঝুরিগুলো যেন কাণ্ডে পরিণত হয় সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ঝুরিগুলো কাণ্ডে পরিণত হলে সেটা দেশীয় এবং জাতীয় ধনতন্ত্রে রূপ নেবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এবং এই কাণ্ডগুলো কারো পক্ষে এখান থেকে মূলসুদ্ধ উপড়ে নেয়া সম্ভব হবে না, যেমন সম্ভব হয়নি কোরিয়া, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরে।